
বাঙলার ইসলাম বা বাংলাদেশের ইসলাম কি আরবের ইসলাম বা পাকিস্তানের ইসলামের চাইতে আলাদা? এর উত্তর নির্ভর করবে আলোচনার প্রেক্ষিতের উপর।
একাডেমিক জায়গা থেকে দেখলে, উত্তর হবে – না। সর্বজনীন ধর্ম হিসাবে ইসলাম একটাই। তবে, স্থানকাল এবং ভাষা ও সংস্কৃতি ভেদে ইসলামের ব্যাখ্যায় ফারাক দেখা যায়। যেকোন ইউনিভার্সাল তথা সর্বজনীন ধর্ম ও মতাদর্শের ক্ষেত্রেই এই কথা খাটে।
আর রাজনীতির জায়গা থেকে দেখলে, উত্তরটা হ্যা হতে পারে। কেননা, রাজনীতিতে সরাসরি জনগণের সাথে কমিউনিকেট করতে হয়। সালাফিবাদীরা আধুনিক সৌদি আরব থেকে ধার করা ইসলামের ব্যাখ্যাকে “সর্বজনীন” এবং একমাত্র ইসলাম বলে প্রচার করে। এদের আলাপের তরিকা পুরাই খারেজিদের মতো। কেননা, এরা বাংলাদেশ্রে ঐতিহ্যবাহী সুন্নি মুসলমানদেরকে অমুসলিম, কাফের, মুরতাদ, মুশরিক ইত্যাদি মনে করে। শিয়াসহ অন্যান্য ধারার মুসলমানদেরকেতো এরা মানুষই মনে করে না। অমুসলিমদেরকেও এরা দাস বানাতে চায়।
এরা হাদিস নিয়ে মিথ্যা প্রচার করে। যেই বাল্কায়েদার পতাকা বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানরা দুই তিন দশক আগেও অপরিচিত ছিল, সেই বাল্কায়েদার পতাকাকে এরা দাবি করে মুসলমানদের “সর্বজনীন” পতাকা। এদের নেতারা সাইকোপ্যাথ, ক্রিমিনাল, ধর্ষক আইসিসের পতাকাকে পর্যন্ত কালেমার পতাকা বলে নর্মালাইজ করতে চায়। এরা বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানকে অমুসলিম ঘোষণা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজ থেকে নিজেদেরকে একরকম খারিজ করে ফেলেছে।
এই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই কথাটা পরিষ্কার করে বলা দরকার যে সালাফি-জিহাদী খারেজিদের ইসলাম এবং বাংলাদেশের ইসলাম এক নয়। বাংলাদশের ইসলামের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। আব্বাসি আমলের হানাফি সুন্নি ঐতিহ্য এখনো দুনিয়ার যেই কয়টা দেশে টিকে আছে, বাংলাদেশ তারমধ্যে একটি। কালামতত্ত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের সুন্নিরা ঐতিহ্যগতভাবে মাতুরিদি আকিদার অনুসারী। অর্থাৎ, আইন তৈরি ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের আক্কেলের গুরুত্বে আমরা বিশ্বাস করি।
কোন মুসলমান ধার্মিক না হইলে, বা শরিয়ত না মানলেই অমুসলিম হয়ে যাবে, এধরণের বিশ্বাসও হানাফি-মাতুরিদি ঐতিহ্যের অনুসারী সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে নাই। হানাফি-মাতুরিদিরা ঐতিহ্যবাহী সুন্নিয়তের আদব অনুসারে ইসলামের অন্তর্গত বৈচিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা যে সালাফি-জিহাদীদেরকে খারেজি মনে করি, তা কোন ধর্মীয় অবস্থান থেকে নয়। বরং রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। মানে, আমরা তাদের অমুসলিম মনে করি না। যাস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করা একটি খারেজি গোষ্ঠী মনে করি। এবং শ্রেফ খারেজি হওয়ার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোন আইনি পদক্ষেপও নিতে চাই না।
এছাড়াও সৌদি আরব এবং সালাফিদের ইসলাম হল হেকমত তথা দার্শনিক জ্ঞান বিবর্জিত ইসলাম। এবং এই ইসলামে মারেফত ও সুফিতত্ত্ব অনুপস্থিত। এই ইসলাম হলো আধুনিক-পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রটেস্টানিজমের একটি ইসলামী সংস্করণ। এর কাজ হলোঃ
১। ইসলামকে কালামতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব, দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রুহানি-শক্তি শূণ্য করে ফেলা। (এই পর্বটি চলেছে গত শতকে)
২। এই প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর ইসলামের নামে উন্মুক্ত পুঁজিবাদ-ভোগবাদ কায়েম করা। (এখন এই পর্বটি চলছে)
অন্যদিকে বাংলাদেশের ইসলাম হলো এখনো সেই হাতেগোনা (যেমনঃ তুর্কিদের ইসলাম) ইসলামী ঐতিহ্যের একটি, যেখানে দর্শন, সুফিতত্ত্ব, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি উপাদানও ইসলামের পরিচয় ও নূর বহন করে। এবং বাংলাদেশের ইসলাম দুনিয়ার অন্য যেকোন জায়গার তুলনায় বিশেষ এইক্ষেত্রে যে এখানে সবসময়ই শরিয়তের বাইরে ইসলামের এলাকাগুলার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতনতা ছিল ও আছে। বেশরা ফকিররা আধুনিক যুগের আগেও আমাদের সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী অংশ ছিল। এখনও আছেন। একবিংশ শতকে আমরা বেশরা ফকিরির ঐতিহ্যের আরবান সংস্করণও উপস্থিতি হইতে দেখছি।
বাংলাদেশের ইসলাম কখনো শরায় সংকুচিত হয়ে যায় নাই। অথবা হয় নাই সংকুচিত নিখাদ রিচুয়ালে। বরং সেই সুলতানি আমল থেকেই আমরা ইসলাম বলতে বুঝেছিঃ
১। শরিয়তঃ শ্রেফ ইসলামী আইন না। বাট আইন ইটসেলফ। এবং কেবল আইনই না, আদবও বটে। এ হলো বস্তুগত ও জীবের জীবন পালনের জন্যে জরুরি নীতি, রীতি, ও আইন।
২। তরিকত
৩। মারেফত
৪। হকিকত
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকেও খোদ মুক্তিযোদ্ধারাই কয়েকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা ছিল একরকম। মাওবাদীদের ব্যাখ্যা ছিল আরেক রকম। জিয়াউর রহমানেরও তো নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা ছিল। ন্যাপের মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনা অফিসারদএর জীবনী থেকে আমরা দেখি যে তারা কেবল জয় বাঙলা স্লোগান দিয়েই যুদ্ধ করেন নাই। ইয়া আলী স্লোগানও দিতেন। ভাসানীর অনুসারীরা কেউ কেউ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসকে কারবালার সাথে তুলনা করেছিলেন। এবং মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এজিদিদের বিরুদ্ধে হোসেনিদের লড়াই হিসাবে।
সুতরাং, কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানী ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন, তাতে দোষের কিছু দেখি না। এমনতো না যে এই ব্যাখ্যা বাকীসব ব্যাখ্যা এবং বয়ানকে বাতিল করে দেয়। বরং, তা মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমাদের চিন্তার গভীরতাই বৃদ্ধি করে। পাকিস্তানের (রাষ্ট্রীয়) ইসলাম ছিল একটি জাতীয়তাবাদী ধারণা, যা মুসলিম ধারণাটিকে রাষ্ট্রের জমিনে একটি রেস বা বর্ণ আকারে উপস্থিত করবার উসিলা ছিল মাত্র। বাঙালি মুসলমান মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামের নামে প্রচার করা এই মুসলিম জাতীয়তাবাদী রেসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এবং তা করতে গিয়ে ইসলামী ঐতিহ্য থেকেও শক্তি নিয়েছেন। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে, মাহফুজের বক্তব্যকে ভুল বলা যায় না।
মতামত