
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাত ১২টার দিকে হলের কিছু শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইল টিম ওই ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক মারা যাওয়ার তথ্যটি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ১২টার একটু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এই লোকটিকে নিয়ে আসে। এরপর ডাক্তার পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করলে এই শিক্ষার্থীদের আর পাওয়া যায়নি। রাত ২টা ১১ মিনিটের দিকে হাসাপাতালে গিয়ে দেখা যায়, লোকটির মরদেহ একটি স্ট্র্যচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
হাসাপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, রাত ১২টায় আনার পর থেকে এই মরদেহ এখানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। রাত পৌনে ৩টার দিকে মরদেহকে মর্গে নিয়ে রাখা হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে ইনচার্জ ফারুক জানান, লাশটির সুরতহাল আমরা করব। এরপর বাকি কাজ শাহবাগ থানার। তারা বাকি পদক্ষেপ নেবেন।
জানা গেছে মৃত লোকটির নাম তোফাজ্জল। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলি ইউনিয়নে। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বিভিন্ন কারণে তিনি অনেকদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন।
মোবাইল টিমের ভাষ্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মোবাইল টিমের একজন সদস্য দৈনিক বাংলাকে বলেন, এফএইচ হল থেকে খবর পাওয়ার পর আমাদের বিকালের টিম রাত আনুমানিক ৯টার দিকে সেখানে যায়। তারা জানতে পেরেছে, ৭টা-৮টার দিকে সেই লোকটাকে শিক্ষার্থীরা আটক করে। বিকেল টিমের ডিউটি শেষ হওয়ার পর আমরা রাতের টিম রাত ১০টা ২০ বা ২২ মিনিটের দিকে হলটির গেস্টরুমে যাই। গিয়ে দেখি লোকটাকে অনেক মারা হয়েছে আর সে সেখানে পড়ে আছে। সেখান থেকে এই লোকটিকে নিয়ে হলের তিনজন হাউস টিউটর, চার-পাঁচ জন শিক্ষার্থীসহ রাত এগারোটায় শাহবাগ থানায় আসি। এরপর থানার ওসির সাথে হাউজটিউটররা কথা বলেন। পরে সেখান থেকে লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। হাসপাতাল থেকে মৃত ঘোষণা করা হলে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে চলে যায়। এরপর আমরাও বের হয়ে চলে আসি।
যা জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
ঘটনার শুরুর বর্ণনা দিয়ে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের হলে আজকে ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলা চলছিল। দুপুরে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়ে আমাদের ছয়টি ফোন চুরি হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমাদের ফুটবল খেলা যখন শুরু হয় তখন সেখানে এই লোকটি আসে। কেউ একজন বলে, এই লোকটিই ফোনগুলো চুরি করে থাকতে পারে। এসময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সে ফোন চুরির বিষয়টি অস্বীকার করলে তাকে ক্যান্টিনে খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে খাবার দিয়ে আমি চলে আসি। এরপর আমি আর কিছু জানি না।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুইজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাকে বলেন, রাত ৮টার দিকে এই লোকটাকে ধরা হয়। শুরুতে হলের মেইন গেস্টরুমে তাকে চড় থাপ্পড় মারা হয়। এরপর তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে জোর করে প্রচুর ডাল আর গোশত খাওয়ানো হয়।
সেখান থেকে নিয়ে হলের এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে তাকে কয়েক দফা পেটানো হয়। এরপর সেখান থেকে আবার মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে এনে তাকে আরও একদফা পেটানো হয়।
এই শিক্ষার্থীরা বলেন, মারের কারণে এই লোক সেখানে শুয়ে পড়ে। শোয়া অবস্থা থেকে লোকটা উঠতেই পারছে না। এসময় তাকে নাচতে জোর করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। অথচ সেসময় লোকটার পিঠ থেকে রক্ত ঝরছে।
এই শিক্ষার্থীরা বলেন, রাত ৯টার কিছু পর থেকে প্রক্টরিয়াল বডির মোবাইল টিম এবং হলের কয়েকজন হাউজ টিউটর গেস্টরুমের বাইরে দাঁড়ানো ছিলো। অথচ সেসময়ও লোকটাকে গেস্টরুমে আটকে রাখা হয়েছে। আর তাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় সাড়ে ১০টার দিকে।
গেইটম্যানের ভাষ্য
হলের মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমের সামনে থাকা একজন গেইটম্যান বলেন, আমি দশটার দিকে ডিউটিতে আসি। তখন দেখি গেস্টরুমের বাইরে হাউস টিউটররা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার আগে দায়িত্বে থাকা গেইটম্যানকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে ভিতরে চোর ধরা পড়ছে।
তিনি বলেন, তবে সে সময় ভিতরে কী হচ্ছে সেটা আমি দেখিনি। এর ১০-১৫ মিনিট পর ভিতর থেকে চিৎকার আসলে হাউস টিউটররা আমাকে বলেন, দেখেন তো গিয়ে কী হচ্ছে ভিতরে। এরপর আমি গিয়ে দেখি ঐ লোকটাকে চড় থাপ্পড় দেওয়া হচ্ছে। তবে আমি যাওয়ার পর আর মারতে দেখিনি। পরে হাউস টিউটর, মোবাইল টিম এবং কয়েকজন শিক্ষার্থী এই লোকটাকে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এরপর রাতে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরলে তাদের কথাবার্তায় বুঝেছি, লোকটা মারা গেছে। তখন এই গেস্টরুমের লেগে থাকা রক্তগুলো তারা মুছে ফেলার প্রস্তাব দিলে বললে আমি অপারগতা প্রকাশ করি।
এদিকে এই ঘটনার পুরো রাত পেরিয়ে গেলেও ঘটনাস্থলে আসেননি হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শাহ মো. মাসুম। ঘটনার সময় বা এর পরে তাকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হয়েছেও বলে জানান শিক্ষার্থীরা। তারপরও রিচ করা যায়নি প্রাধ্যক্ষকে। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদও একাধিকবার ফোন দিয়ে পাননি এই প্রাধ্যক্ষকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং সহকারী প্রক্টররা আসার খবর পেয়ে সকাল সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন অধ্যাপক ড. শাহ মো. মাসুম।