
গবাদিপশুর খাবার তৈরির সরকারি কারখানাটি উদ্বোধন করা হয়েছিল প্রায় দুই বছর আগে, ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি। সেদিন তৎকালীন প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন, প্রাণীর পুষ্টিকর খাবারের জন্য আর বিদেশনির্ভর হতে হবে না।
সাবেক মন্ত্রী এখন আত্মগোপনে। কারখানাটি চলেছিল ওই এক দিন, যেদিন তিনি উদ্বোধন করেছিলেন। তার পর থেকে বন্ধ। বাণিজ্যিকভাবে কারখানাটি কবে চালু হবে, কোনো দিন চালু হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। যদিও ইতিমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৩৩ কোটি টাকা।
সয়াবিন তেল ফেরত দিয়ে টাকা নিলেন মনোয়ার হোসেন। বিষণ্ন মুখে ফিরে যাচ্ছেন। পা তাঁর চলছে না, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখনও লাইনে থাকা অসংখ্য মুখে খিস্তি। গরিবের জিনিস নিতেও মানুষগুলোর বিবেকে বাধে না!
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী লিপিকার মোড়ে টিসিবি ট্রাকের সামনে এ ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে। এখানে হযরত এন্টারপ্রাইজ সয়াবিন তেল ও ডাল সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করছে। কথা বলে জানা যায়, মনোয়ার সরকারি চাকরিজীবী। মূল্যস্ফীতির চাপে সত্যিই তিনি অসহায়। বললেন, ‘পেট না চললে, বিবেক দিয়ে কী করব? কিন্তু হাত থেকে যখন মানুষ তেল কেড়ে নেন, কিছু করার থাকে না। বাধ্য হয়ে টাকা ফেরত নিয়েছি।’
বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতি চললেও আয় বাড়েনি মানুষের। ফলে সংসার সামাল দিতে মনোয়ারের মতো অসংখ্য মানুষ এখন টিসিবির পণ্য কিনছেন। এখানে আর গরিব বলে আলাদা করার সুযোগ থাকছে না। অনেক বাড়ির মালিক গৃহকর্মী পাঠিয়ে পণ্য কিনছেন।
টিসিবি দিনে জনপ্রতি ২ লিটার সয়াবিন তেল ও ২ কেজি মসুর ডাল বিক্রি করে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০ এবং প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম নেয় ৬০ টাকা। বাজারে এখন সয়াবিন তেল ১৭৫ এবং মসুর ডালের কেজি ১০৫-১১০ টাকা। পরিবারের একজন পণ্য দুটি কিনলে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা সাশ্রয় হয়। সদস্য বৃদ্ধি করলে বাড়ে সাশ্রয়ের অঙ্কও। এ জন্যই ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাকের অপেক্ষায় থাকছেন বহু মানুষ। বিক্রি শুরুর পর রীতিমতো ‘যুদ্ধে’ শামিল হচ্ছেন তারা।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির সমকালকে জানান, সক্ষমতা অনুযায়ী তারা পণ্য দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয় সরবরাহ না করায় চাল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। আর নিয়ম অনুযায়ী বাজারে আলু ও পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি করা হচ্ছে না।
সাতরাস্তা মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাক, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সোয়া ৩টা। সয়াবিন তেলের বোতল আছে ১২টি। কিন্তু তখনও ৩৭ নারী-পুরুষ লাইনে। বিক্রয়কর্মী মো. বিপ্লব বললেন, আর ১০ জন পাবেন। এর পরই সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহবুব হাসান বললেন, বেগুনবাড়ীতে শেষ হয়ে যাওয়ায় দৌড়ে এখানে এলাম। পেলাম না। দিনটিই মাটি।
টিসিবি কর্মকর্তারা জানান, দিনে প্রতিটি ট্রাকের মাধ্যমে ৮০০ কেজি ডাল ও ৮০০ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন তারা। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৪০০ জন পণ্য কিনতে পারছেন। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ৫০টি ট্রাকের সুবিধাভোগী বড়জোর ২০ হাজার। তাও ডিসেম্বর থেকে সরবরাহ না থাকায় চাল, আটা, আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রামপুরা টিভি সেন্টার, হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজ, চৌধুরীপাড়া পেট্রোল পাম্প, জাতীয় প্রেস ক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারা, মৎস্য ভবন, বেগুনবাড়ী, সাতরাস্তাসহ অন্তত ১০ স্পট সরেজমিন ঘুরে দেখার সময় কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় অর্ধেক মানুষ পণ্য পাচ্ছেন না। নির্দিষ্ট সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ায় একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। প্রায় সবখানে দেখা যায়, ক্রেতাদের মধ্যে শৃঙ্খলা রাখতে ট্রাকের কর্মীরা মার্কার দিয়ে সিরিয়াল নম্বর হাতে লিখে বসিয়ে রাখছেন।
রামপুরা টিভি ভবনের বিপরীতে ইউটার্নের পাশে কাপড়ের ব্যাগ হাতে বসে চোখ মুচছেন আসমা বেগম। পাশেই টিসিবির পণ্য বিক্রি শেষ হওয়ায় চলছে হুলস্থূল। বুঝতে বাকি নেই আসমার কান্নার কারণ। বললেন, ‘হেই সকাল ১০টা আর ১২টার দুই বাসার কাম বাদ দিয়া আইছি। এরুম ধাক্কাধাক্কি করে সবাই, আমি পইড়া হাঁটুত ব্যথা পাইছি। না পাইরলাম নিতে কিছু, না কইরলাম দুই বাসার কাম।’
এখানে টিসিবির পণ্য বিক্রেতা বশির উদ্দিন জানান, ৪০০ জনকে দেওয়ার পর কিছুই করার থাকে না তাদের। গাড়ি দেখে সবাই আসে। আগে থেকে জানানো হয় না।
এখানে স্কুলপড়ুয়া সবুজ মিয়া বলে, ‘মা অসুস্থ থাকায় মাইনষের বাসায় কামে যায় নাই। আমারে কিনতে পাঠাইছে। বড় বড় মাইনষের জন্য টেরাক নাগালেই পাই না। আইজ খালি হাতে বাড়ি গেলে খাওন জুটব না।’
টিসিবির পণ্য নিতে এখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাও ভিড় করছেন। মধ্যবিত্তরা মাস্ক, মাফলার মুখে পেঁচিয়ে লাইনে থাকছেন। উচ্চবিত্তরা বাসার দারোয়ান, গৃহকর্মী ও অন্যদের পাঠাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, সরকারি চাকরিজীবী হলেও, এখন টিসিবির পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছি। অফিসে না গিয়ে সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় মিথ্যা বলে এসেছি, জরুরি কাজে যাচ্ছি। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই ট্রাক থেকে পণ্য কিনছি। নিজেকে খুব অসহায় লাগে।
হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজের পাশে টিসিবি ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। রোড ডিভাইডারেও বসে অনেকে। কয়েকজন জানান, বিক্রি শুরু হয়েছে সকাল ১০টার কিছু আগে। দুপুরেও অনেকে পণ্য পাননি। দিনমজুর খায়রুল ইসলাম ও আম্বিয়া বেগমের অভিযোগ, ‘মগবাজার আমবাগান ও গাবতলায় টেরাক আহে না। এদিকেও আহে ম্যালা দিন পর পর। আমগোর আইতে কষ্টও হয়, সময়ও নষ্ট হয়। দেহেন, আইজকা কুনু কাম করতে পারলাম না। খাড়ায়া থাইকা ঠ্যাং ধইরা গ্যাছে গা। হাতে নম্বর লেইখ্যা কাগজ ধরায়া দেয়, পণ্য দেয় না।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে টিসিবির পণ্যের সরবরাহ ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি। প্রয়োজনে এডিপির অব্যবহৃত অর্থ ব্যয়ে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এ দেশে রমজানে সবকিছুর দাম বাড়ে। এ জন্য সরকারকে এখনই প্রস্তুতি রাখতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। বাজারে পণ্যের দর বেশি থাকায় মানুষ টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটছেন। ফলে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। প্রয়োজনে মাঝারি মানের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে এলসি খুলতে সহায়তা করে টিসিবির পণ্য আমদানি করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। এম এ রাজ্জাক মনে করেন, টিসিবির জন্য নতুন সরকারের কোনো বাজেট নেই। ফলে তারা এডিপির অব্যবহৃত কিছু অর্থে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ালে বহু মানুষ উপকৃত হবেন।