
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা চায় বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার রোডম্যাপ স্পষ্ট না করলে রাজপথে নামবে বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
সভা সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান হচ্ছে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবে, যাতে করে সরকার একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে। দলটি মনে করে, সরকারের রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ, বিএনপিও প্রয়োজনীয় সংস্কার চায়। এজন্য দলটি সরকারের সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সহমতও পোষণ করেছে।
তবে নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত সোমবার রাতের ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বৈঠকে সংযুক্ত ছিলেন।
মেয়াদের তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এখনো রোডম্যাপের বিষয়টি স্পষ্ট না করায় নির্বাচন নিয়ে আসলে তাদের চিন্তা কী, অথবা নির্বাচন ছাড়া তারা কত দিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কিংবা তারা ক্ষমতা ও নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করতে চায় কি না, এটা নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নেতারা বৈঠকে এমন অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, সরকার সংস্কারের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে তাদের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। তাই তারা সরকারকে অবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানান।
এ সময় বলা হয়, সরকার ঘোষিত দশটি সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকেও ছয়টি ছায়া কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সুপারিশমালা তারা সরকারকে দেবে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা অব্যাহত থাকবে। তাদের রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখায়ও সংস্কারের কথা বলা আছে। তবে দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা এখন ভোট দিতে উদগ্রীব। জনগণ দ্রুত নির্বাচন চায়। তাই সরকারের উচিত, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন এবং বিচার বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর জন্য বলা হয়েছিল।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে সরকারের দুয়েকজন উপদেষ্টা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটাকে ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। সোমবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
‘রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উশখুশ করছেন’-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে গত রোববার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই দিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আবারও চক্রান্ত করে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করতে যাবেন না। এটা বাংলাদেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। একবার বিরাজনীতিকরণের ‘মাইনাস টু’ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আবারও ওই রাস্তায় যাওয়ার কথা কেউ চিন্তা করবেন না।
এ ছাড়া গত মঙ্গলবার জ্বালানি উপদেষ্টার দেওয়া এক বক্তব্যকে পাল্টা কটাক্ষ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বর্তমানে সংস্কারের কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। নির্বাচন নিয়ে আপনারা কোনো কথা বলছেন না। আমরা নির্বাচনের কথা বললেই আপনারা বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমরা উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছি। এখন আমরা যদি বলি, আপনারা নির্বাচনের কথা না বলে ক্ষমতায় থাকার জন্য পাগল হয়ে গেছেন। সুতরাং কোনো রকম ছলচাতুরি করবেন না। জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখবেন, তারা তামাশা দেখবে, এমনটা হবে না।’
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এখনো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা সময় নির্ধারণ নেই। বরং গত সোমবার নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হাকোন অ্যারাল্ড গুলব্রান্ডসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম আগের মতোই বলেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা উপদেষ্টার এই বক্তব্যের ঘোরতর আপত্তি জানান। তারা বলেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তো ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েই আছে। এখানে নতুন কোনো ঐকমত্য হওয়ার কিছু নেই। ফলে সরকার নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কি না, উপদেষ্টা নাহিদের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সে বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন নেতারা।
এদিকে সরকার এখনো নির্বাচনী রোডম্যাপ স্পষ্ট না করায় দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বৈঠকে তারা অভিমত দেন, রোডম্যাপ স্পষ্ট করলেই বর্তমান অস্থির অবস্থা কেটে যাবে। এর মধ্য দিয়ে দেশও নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করবে। ফলে তখন সবাই নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বেন। নইলে নতুন নতুন ইস্যু আসতেই থাকবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটি অবিলম্বে তার পদত্যাগ চায়। কারণ, আলী ইমাম মজুমদারকে বিতর্কিত কর্মকর্তা মনে করেন তারা। সে কারণে তাকে সরকারে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিমত নেতাদের।
বৈঠকে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি জোরালোভাবে পালনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই কর্মসূচি শেষে নতুন কর্মসূচি দেওয়া নিয়েও আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে দেশব্যাপী সাংগঠনিক জেলাগুলোতে সমাবেশের কর্মসূচি আসতে পারে। তবে পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখাকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক আকারে তুলে ধরারও সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।