
নুরজাহান আক্তার, নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা।
অবশেষে আসল পরিচয় মিলেছে ভুয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারীর। তার নাম কামরুল ইসলাম হৃদয়। একসময় পুরান ঢাকার গৌরসুন্দর রায় লেনে থাকলেও এখন থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। তার বাবা, ভাই, স্বজনেরও বসবাস কামরাঙ্গীরচরে।
কামরুল নিজেকে পরিচয় দিতেন নবাব সলিমুল্লাহর নাতি হিসেবে। নবাবদের শেষ বংশধর বলেও দাবি করতেন। বলতেন, তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, দুবাইতে তাদের রয়েছে স্বর্ণের কারখানা। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালেও নাকি মালিকানা রয়েছে তার!
সম্প্রতি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী নামের ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এর পরই বেরিয়ে আসে নবাব পরিচয়ে তার প্রতারণার কাহিনি। তাকে রিমান্ডে নিলেও দাবি করতে থাকেন, তিনিই নবাব পরিবারের শেষ বংশধর। এর পরই সিটিটিসি কর্মকর্তারা তার স্বজনদের খুঁজতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে তার সব পরিচয়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপকমিশনার মাহফুজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নবাব খাজা আসকারী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি ভয়ংকর প্রতারক। নবাব এস্টেটের সম্পত্তি দখলের পাশাপাশি এই ভুয়া নবাব টার্গেট করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। প্রতারণা করে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। তার আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, কামরুল ইসলাম বিহারি পরিবারের সন্তান। একসময় পুরান ঢাকার গৌরসুন্দর রায় লেনে একটি বাসায় থাকতেন। সেখানে উত্তারাধিকার সূত্রে তার বাবা আবদুস সালাম যে সম্পদ পেয়েছেন, তা বিক্রি করে ২০১১ সাল থেকে তিনি কামরাঙ্গীরচরে বসবাস শুরু করেন। তবে আসকারী ওরফে কামরুল তার বাবাকে স্বর্ণ কারখানার মালিক পরিচয় দিতেন। প্রতারক কামরুলের মা নাইমা খাতুন মারা গেছেন আগেই। বাবা দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। কামরুলের সাত ভাই, দুই বোনের মধ্যে বড় ভাই সাইফুল ইসলাম ও ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী মারা গেছেন। আমিনুল ইসলাম নামে আরেক ভাই কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। বাকি তিন ভাই আহাম্মদ আলী, মো. রাজা ও মো. রানা ভুয়া নবাব আসকারীর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তারা তাদের ভাইকে স্যার বলে ডাকতেন।
সূত্র আরও জানায়, কামরুল ২০০৩ সালে দুবাই যান। সেখানে ‘হাজী বিরিয়ানি’ নামে একটি খাবারের দোকান দেন। ব্যবসায় স্থায়ী হতে না পেরে দেশে ফিরে প্রতারণা শুরু করেন। তবে স্বজনরা জানতেন, কামরুল দুবাইতে মারা গেছেন। দেশে ফিরে কিছুদিন খাজা নবাব সৈয়দ কামরুল হাসান নাম ধারণ করেও প্রতারণা করেছেন তিনি। তখন তার বাবার নাম লিখেছিলেন ড. আবদুস সালাম।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তারা ভুয়া নবাবের বাবা ও বোনদের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের কাছে কামরুলের বিষয়ে আরও তথ্য নেওয়া হবে। এর মধ্যে তার চাচাতো ভাইসহ কয়েক স্বজন কামরুলের আসল পরিচয় পেতে সহায়তা করেছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতারক কামরুল নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী নামে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরি করেন। সেটি দিয়ে দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি করেন। ওই পাসপোর্ট দেখিয়ে নবাব পরিচয় দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রও নেন। এগুলো কীভাবে পেল সে বিষয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে।
কথিত এই নবাবের চাচাতো ভাই তাজুল ইসলাম বলেন, আসকারী নামে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি তার আপন চাচাতো ভাই। তার আসল নাম কামরুল ইসলাম হৃদয়। ১০-১২ বছর ধরে তার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানা রয়েছে- এমন প্রচারণা চালিয়ে কামরুল সেখানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়ার পর বহু লোক প্রায় প্রতিদিনই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় জমি কিনে দেওয়ার কথা বলেও তিনি টাকা হাতিয়েছেন। এমনকি নবাব পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তির স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে এফিডেভিট করে তাকেও নবাব পরিবারভুক্ত করে নেন তিনি।