
শহিদ সরকার :
গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস যেন সেবা নয়, দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। এখানে সেবা নিতে আসা মানুষজনকে দালালের দ্বারস্থ না হলে কোনো কাজই এগোয় না। ইউনিয়নের নয়টি এলাকার মানুষের জন্য এই অফিস এক অভিশাপে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উদ্যোগে ডিজিটাল ভূমি সেবা চালু হলেও এই অফিসে তা কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। অফিসের পাশেই দালালরা তৈরি করেছে বিকল্প “ভূমি অফিস”, যেখানে প্রকাশ্যে চলছে সরকারি নথি ঘাঁটাঘাঁটি, ল্যাপটপে সার্ভারে কাজ এবং বিকাশ-নগদের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন। সরকারি অফিস থেকে সেবা না পেয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাওয়াল মির্জাপুর বাজার থেকে উত্তরের রাস্তার চাররাস্তার মোড় ঘেঁষে তিনতলা সাদা ভবনের নিচতলায় পশ্চিম ইউনিটে দালালদের আস্তানা। কক্ষভর্তি নথি, কম্পিউটার ও ল্যাপটপে ব্যস্ত দালাল আশরাফুল ইসলাম, দেয়ালে টানানো কিউআর কোডে চলছে টাকা লেনদেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে মূল হোতা আবু সাঈদ দৌড়ে পালান, অন্যরা দরজা বন্ধ করে ভেতরে লুকিয়ে পড়েন। স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. দুলাল মিয়া ও সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মব সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের ওপর হামলার চেষ্টা হয়। দেড় ঘণ্টা অবরুদ্ধ রাখার পর ভেতরে থাকা দালাল শহিদুল ও তার সহযোগীরা বের হন, ততক্ষণে ভেতরের সরকারি নথি গায়েব হয়ে যায়।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, সরকারি ফি’র আট থেকে দশগুণ বেশি টাকা দালালদের দিতে হয়। অফিসে সরাসরি আবেদন করলে অনেক সময় প্রস্তাব এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয় না, অথচ দালালদের মাধ্যমে করা কাগজ তৎক্ষণাৎ পাঠানো হয়। এভাবে দালাল চক্রই হয়ে উঠেছে “সর্বশেষ ভরসাস্থল”।
দালাল আবু সাঈদ, শহিদুল, আশরাফুল, হান্নান ও রুবেল দীর্ঘদিন ধরে এই অফিসে সিন্ডিকেট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। অল্প সময়ে তাদের কোটিপতি বনে যাওয়া স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র প্রশ্ন তুলেছে। রাঙ্গামাটি নীড় আবাসিক এলাকায় আবু সাঈদের সাততলা, ছয়তলা ভবন, দামি গাড়ি ও ফ্ল্যাট ব্যবসা সবই তার দালালি থেকে অর্জিত বলে অভিযোগ। শহিদুল দীর্ঘ ১৫ বছর উমেদারি আর দালালি করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, আশরাফুল নাটোরের সাধারণ পরিবার থেকে গাজীপুরে বাড়ি-জমির মালিক বনে গেছেন, আর হান্নান সন্ত্রাসী স্টাইলে অফিসে আধিপত্য বিস্তার করেন।
এ সিন্ডিকেটকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন ভূমি অফিসেরই কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা প্রতিদিন বিকেলে দালালদের বিকল্প অফিসে গিয়ে অর্থ ভাগাভাগি করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় ও রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া এমন প্রকাশ্য দুর্নীতি সম্ভব নয়।
নামজারি করতে আসা রফিকুল ইসলাম জানান, প্রথমে একজন নিজেকে কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে টাকা নিয়েছিলেন, পরে জানতে পারেন তিনি দালাল।
এসব বিষয়ে মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. মাহবুব হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দালালদেরকে চিনি ও জানি। তারা আগে অফিসে সরাসরি কাজ করতো এখন বাইরে থেকে কাজ করে। ভূমি অফিসের পাশে দালালদের ‘বিকল্প অফিস’ কীভাবে গড়ে উঠল, এর দায়ভার আপনি নিবেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জেলা প্রশাসন দ্রুত হস্তক্ষেপ করে দালাল সাম্রাজ্যের চিত্র উন্মোচন করবে এবং প্রকৃত ভূমি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।