
স্টাফ রিপোর্টার :
মো. আলম মিয়া (৪৬) ছিলেন এয়ার ফোর্সের চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী (প্রহরী/ওয়াচম্যান)। ২৬ বছর চাকরি করার পর ২০২৫ সালে অবসরে যান তিনি। পতিত হাসিনা সরকারের শাসনামলে দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তার যত জায়গা-সম্পত্তি আছে সবই স্ত্রী আছমার নামে। আছমা একজন গৃহিণী। মূলত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাত থেকে বাচতেই সব সম্পত্তি স্ত্রীর নামে করেছেন ধুরন্ধর আলম মিয়া।

খোজ নিয়ে জানা যায়, আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী পাস। তার এয়ার ফোর্সে চাকরি পাওয়া নিয়ে রয়েছে একটি ঘটনা। জানা যায়, আলমের শাশুড়ি একসময় এয়ার ফোর্সে আয়া ছিলেন। সদ্য বিবাহিত আলম কিছুই করতেন না, কোনোভাবে টেনেটুনে সংসার চলতো। কিছুদিন পর আলমের শাশুড়ি এয়ার ফোর্সের সিনিয়র অফিসারদের কাছে কাকুতি-মিনতি করে তাকে প্রহরীর চাকরি জুটিয়ে দেন। ১৯৯৯ সালে আলম চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে এয়ার ফোর্সে যোগদান করেন। এরপর নানা কূটকৌশলে তিনি ব্যাপক ধনসম্পদের মালিক হন।
ঢাকায় আসার পর প্রথমে আলম ভাড়া বাসায় থাকতেন। শুরুতে তিনি ঢাকার মিরপুরের মানিকদী এলাকার বাইগারটেকে রিকশা চালাতেন। এরপর লেগুনার হেলপার ও ড্রাইভার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চলাচলরত ৪নং বাসের হেলপারি করেন। ধীরে ধীরে হেলপার থেকে লাইনম্যানের দায়িত্ব পান। এর মাঝেই আছমার সঙ্গে তার প্রেম হয়। পরে আপত্তিকর অবস্থায় দুজনকে এলাকাবাসী হাতেনাতে আটক করে বিয়ে দিয়ে দেয়।

এয়ার ফোর্সে প্রহরী হিসেবে যোগদানের পর বাইগারটেকের আজিজ মার্কেট এলাকায় একটি সমিতি খুলে সুদের ব্যবসা শুরু করেন আলম। এ কারণে এলাকায় ‘আলম সুদ ব্যবসায়ী’ নামেও তিনি পরিচিত। এর পাশাপাশি আলম জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে এলাকার মধ্যে বড় জুয়াড়ি বনে যান।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, যদি কেউ সুদের টাকা পরিশোধ করতে অপারগ হতেন তাহলে আলম তাকে আজিজ মার্কেটের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করতেন। সুদের ব্যবসা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলাকায় আধিপত্যও বিস্তার করতে থাকেন। তার বিরুদ্ধে যারাই যেতেন তাদের নিজের তৈরি টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। এরপর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের টাকা-পয়সা দিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকেন। 

আলম মিয়া তার তিন মেয়েকে একই এলাকায় বিয়ে দিয়েছেন। তার দুই জামাই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। আলমের ছোট জামাই জয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন ১৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার নামে গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র হত্যা মামলা রয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে আলমের দুই জামাই পলাতক। আরেক জামাই বালুরঘাট এলাকায় ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। হাসিনার আমলে জামাইদের নিয়ে আলম এলাকায় মাটির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দালালি ও আধিপত্য বিস্তার করেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরও আধিপত্য কমেনি আলমের। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা দিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন তিনি।
আলমের সম্পদের বিবরণ :
এয়ার ফোর্সের সামান্য প্রহরী হলেও আলম মিয়ার সম্পদের বিবরণ একরকম মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো। মাত্র চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে ২০তম গ্রেডে বেতন পেয়ে তিনি যে সম্পদ করেছেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর পল্লবী থানার বাইগারটেক আজিজ মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় দুই কাঠার ওপর চারতলা একটি ভবন রয়েছে আলমের। এ বাসায় তিনি নিজে থাকেন এবং অন্যান্য ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন।
এই বাড়ির এক গলি পরেই পৌনে দুই কাঠা জমির ওপর দুই তলা একটি বাড়ি রয়েছে আলমের। এটি পুরোটাই ভাড়া দিয়েছেন। খোজ নিয়ে জানা যায়, এ এলাকায় বর্তমানে এক কাঠা জমির মূল্য ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া সম্প্রীতি দেড় কাঠা জমির বায়না দিয়েছেন একই এলাকায়। এটি এয়ার ফোর্সের বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে।

বাড়ি ছাড়াও বিশাল একটি অটোরিকশার গ্যারাজ, মুরগির খামার ও একটি জেনারেল স্টোরের মালিক আলম মিয়া। তার বিশের অধিক অটোরিকশা রয়েছে, যার প্রতিটির বাজারমূল্য আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। ‘নদী পরিবহন’ নামে মানিকদী থেকে ইসিবি চত্বর পর্যন্ত রিকশাগুলো ভাড়ায় চলাচল করে।
রিকশার মালিক হলেও আলমের চলাফেরা টয়োটা ব্র্যান্ডের দামি প্রাইভেট কারে। এছাড়াও FZ-V3 এবং R-15 লেটেস্ট ভার্সনের দুটি মোটরসাইকেল রয়েছে তার।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আরো বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। গাজীপুরে আছে প্লটসহ একটি বাড়ি। ব্যাংকে গচ্ছিত আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। তার স্ত্রীর রয়েছে অন্তত ১০-১৫ ভরি স্বর্ণ। আলম নিজেও গলায় স্বর্ণের মোটা চেইন ও হাতের প্রতিটি আঙুলে স্বর্ণের আংটি পরেন। সর্বমোট তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বলে ধারণা করা যায়।
আলমের যত অপকর্ম :
এমন কোনো অপকর্ম নেই যার সঙ্গে যুক্ত নন আলম মিয়া। তিনি চাঁদাবাজি, দালালি, প্রতারণা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদক ব্যবসা, প্রাণনাশের হুমকি প্রদানসহ নানা অপকর্মে জড়িত। আওয়ামী লীগ আমলে দলটির এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন আলম। দলের প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় বিস্তার করেন আধিপত্য। দলিল জালিয়াতি ও জমি জবরদখলের মতো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর জানা যায়, সরকারি টর্চার সেল ‘আয়নাঘরে’র কথা। আলমেরও এমন টর্চার সেল ছিল। তিনি সেখানে নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন।
২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর নিজের খোলসও বদলে ফেলেন চতুর আলম মিয়া। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে আবারও নিজের আধিপত্য ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি এবং সফলও হন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি ‘মব ভায়োলেন্সে’ নেতৃত্ব দেন। এর মধ্যে কিছুদিন আগে ইসিবি চত্বরের এক বাসার ছাদে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মব ভায়োলেন্স করান। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, তাদের থেকে প্রায় পাচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় আলমগং। সে সময় দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ভুক্তভোগীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
আলমের প্রতারণার শিকার আশরাফি আহসান ইতি যায়যায়দিনকে বলেন, আমার স্বামীর চিকিৎসা ব্যয় জোগাড় করার জন্য দুটি প্লট বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক করে প্লটগুলো বিক্রি করে দেয়ার কথা বলে আলম আমার কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা নেন। পরে আরো একটি প্লট বিক্রি করে দেয়ার কথা বলে ছয় লাখ টাকা নেন। এখন টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করছেন আলম। আমাদের এলাকার অনেক গরিব মানুষ তার ভয়ে পালিয়ে গেছেন। আলমের যে পরিমাণ সম্পত্তি আছে তা এয়ার ফোর্সের একজন সিনিয়র অফিসারেরও নেই । আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
মব ভায়োলেন্সের শিকার ইবাদত হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, সন্ত্রাসীদের নিয়ে আলম আমাদের ওপর হামলা চালান। নির্যাতনের পর মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করে। আলম বিগত সরকারের আমলেও ছিনতাই, চাদাবাজি করতেন। ৫ আগস্টের পরও করে চলেছেন।
তিনি আরো বলেন, মাত্র ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে আলম কিভাবে এত সম্পদের মালিক হন? আমি লাখ টাকার ওপরে বেতন পায়, তবুও সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাই ।
আরেক ভুক্তভোগী এনামুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, আলমের নেতৃত্বে কিছু মাদকাসক্ত ও বখাটে সন্ত্রাসী আমার ওপর আক্রমণ করে। তারা আমাকে একটি বদ্ধঘরে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। আমাকে জিম্মি করে আমার এটিএম কার্ড থেকে টাকা উত্তোলন করেন আলম।
অভিযোগের বিষয়ে যায়যায়দিন অভিযুক্ত আলম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আপনি তো সবই জানেন। তারপরই আলম বলেন, আমি সব সম্পত্তি ব্যবসা ও অটোরিকশা থেকে করেছি। এরপর তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোনের লাইনটি কেটে দেন।