
নিজস্ব প্রতিনিধি :
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন। এই কমিশন গঠনের আইন, ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ’ ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে দলটি। এমনকি বর্তমান কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ারও কথা বলছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকেও আনুষ্ঠানিকভাবে এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে এনসিপি। এ ছাড়া মৌলিক সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে নিজেদের দ্বিধার কথাও জানিয়েছেন তারা। তবে ইসি পুনর্গঠনের কথা বলা হলেও আগামী রোববার এ কমিশনের কাছেই দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবে নবগঠিত এ দলটি।
এদিকে তরুণদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হলেও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে দেখছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে কমিশন পুনর্গঠনের দাবিকে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি। ইসিও বলছে, তারা পুরোপুরি নিরপেক্ষভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। ইসি পুনর্গঠনের দাবিটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।
এনসিপি নেতারা বলছেন, ২০২২-এর আইনের অধীনে এই ইসি গঠন করা হয়। তাদের দাবি, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নতুন ইসি গঠন করতে হবে। কমিশনের সদস্যরা নিরপেক্ষ নয় বলে মনে করেন তারা। নির্বাচনের আগে এই কমিশন পুনর্গঠন করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতারা।
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন কালবেলাকে বলেন, এই নির্বাচন কমিশন একটি দলের প্রতি আজ্ঞাবহ। এরই মধ্যে তারা আস্থা হারিয়েছে। কমিশনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতিও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, এই কমিশন আগের হাসিনার আমলের কমিশনের মতোই আচরণ করছে। তাই তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে অক্ষম। এজন্য অবশ্যই বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন আইন পরিবর্তন করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন আইন করতে হবে এবং কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতেও নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করছে এনসিপি। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ইসি এ মামলায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি এবং আপিলও করেনি। ফলে এটা খুবই স্পষ্ট যে, তারা একটা দলের পক্ষ নিচ্ছে, একটা প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছে। এই কমিশনের ওপর জাতীয় নির্বাচন বা যে কোনো নির্বাচনে আস্থা রাখা যাচ্ছে না।
গত ৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমে করা এক মন্তব্যে নাহিদ আরও বলেছিলেন, আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। জনমতের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে জুলাই সনদ প্রণয়ন করলে নির্বাচনে এনসিপির কোনো দ্বিমত নেই।
তার ভাষ্য, নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। অথচ কমিশনের গঠন প্রক্রিয়াতেই গলদ রয়েছে। এসব বিষয়ে ফ্যাসিবাদী আমলেই বিরোধিতা করেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ইসি সংস্কার কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী কমিশন পুনর্গঠন হওয়ার কথা। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষ লোকদের দায়িত্ব দিতে হবে। যারা সব পক্ষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম।
এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) বেশিরভাগ কমিশনারই বিএনপিপন্থি এবং সে সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও বর্তমান ইসিকে বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে অবহিত করছেন এনসিপির নেতারা। দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোওয়ারী বলেছেন, ইসি এখন আর কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এক্সিস্ট করে না। এটি বিএনপির একটি দলীয় কার্যালয় হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এটা বিএনপির একটা মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসি পুনর্গঠন ছাড়া এনসিপি কোনো ভোট করতে দেবে না।
ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে উল্লেখ করে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কালবেলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ইসি যেভাবে দায়িত্ব পালন করছে, সেক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরাও এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছি। আমরা আমাদের জায়গা থেকে বারবার বলে আসছি, জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার, জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমেই মূলত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ইসির ভূমিকা নিরপেক্ষ দেখিনি। সেজন্য আমরা পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছি এবং ইসির সামনে কর্মসূচি পালন করেছি। আগামীতেও আমরা গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করব। তবে আমরা আশা করছি, সরকার এরই মধ্যে এটি আমলে নেবে এবং ইসি পুনর্গঠন করা হবে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, বর্তমান ইসি পক্ষপাতহীন আচরণের বদলে একপাক্ষিক আচরণ করছে, যা তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমান ইসি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাগুলোকে নিয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে অনেক ক্ষেত্রেই। তাই আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি, এই নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করে নির্বাচন আয়োজনের দিকে যেতে।
নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় আপনারা আপত্তি জানিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে আখতার বলেন, এই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় ২০২২ সালের আইনে। যেদিন গঠন করা হয়, সেদিনই আমরা নাগরিক কমিটির ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা বলেছিলাম, ২০২২ সালের ফ্যাসিবাদী আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো, এটা ঠিক নয়। বরং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী আইন সংশোধন করার পর নির্বাচন কমিশন গঠন করা উচিত। আমরা এখন নয়, ইসি গঠনের সময়ই এই আপত্তি জানিয়ে রেখেছিলাম।
এ ছাড়া জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ, বিচার এবং মৌলিক সংস্কার নির্বাচনের আগে যথাযথভাবে না হলে আমরা নির্বাচনে যাব কি না সেটা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন এনসিপির সদস্য সচিব।
এদিকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ব্যাপারে এনসিপির সঙ্গে একমত না হলেও কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন চাই না। তবে আমাদের মনে হয়েছে, কমিশনের কিছু কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। সিইসিসহ অনেক কমিশনারই অগ্রিম বক্তব্য দিয়েছেন। সরকার ঘোষণার আগেই তারা ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি ঘোষণা করেছেন। তাদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে পক্ষপাতের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ইস্যুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আদালত নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করে বিব্রতবোধ করেছেন। মন্ত্রণালয় বলেছে, তাদের মতামতের আগেই ইসি মেয়রের গেজেট প্রকাশ করে দিয়েছে। সেজন্য এখনো মেয়র ইস্যুতে অচলাবস্থার অবসান হয়নি। কমিশনের এসব কর্মকাণ্ডে মানুষের মতে আস্থার চিড় ধরেছে। এর দায়ভার কমিশনকেই নিতে হবে। সেজন্য আপামর জনগণের মতো আমরাও কমিশনের ওপর সন্তুষ্ট নই।’
শুরুতেই কমিশনের বিরোধিতা না করে স্বাগত জানানো হয়েছিল কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘এত রক্তের অভ্যুত্থানের পর একটি কমিশন গঠন হয় এবং তারা সে সময় সুন্দর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন; কিন্তু তারা সে কথা রাখতে পারেননি।’
এদিকে জামায়াত ও এনসিপির মতের সঙ্গে মোটেও একমত নয় বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, কমিশন এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই রয়েছে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রদের দল এনসিপিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ মুহূর্তে কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র এবং তা হাস্যকর।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এ সরকারের আমলেই গঠিত হয়েছে। আর তারা (এনসিপি) তো সরকারেরই একটি অংশ। এখনো সরকারে তাদের দুজন প্রতিনিধি রয়েছে। তারা ইসি নিয়োগ দিয়ে তারাই আবার বলছে হবে না। এটা হাস্যকর।’
ইসি পুনর্গঠনের দাবির বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক’ হওয়ায়, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন কমিশনের সদস্যরা। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা কোনো মতামত দিতে চাই না। তবে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’