
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার ঐতিহাসিক লন্ডন বৈঠকের পর বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রনাট্য অনেকখানি বদলে গেছে। তবে, এই সময়ের বহুল আলোচিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী যারপরনাই বিক্ষুব্ধ হয়েছে। হতাশ তো বটেই।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি ক্ষুব্ধ হবে এটার কারণ সবার জানা। তাদের রাগের কারণ হতে পারে বিএনপি ক্ষমতার ভাগ বসাতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী? কেউ কেউ বলছেন- এতদিন তো জনশ্রুতি ছিল জামায়াতই সরকারের চালিকাশক্তি। বাস্তবে তার আলামতও ছিল। সরকারের ভেতরে জামায়াতের শেয়ারহোল্ডার নেহায়েত কম নয়।
প্রশাসন তো একচেটিয়া তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। শীর্ষ পদগুলো তাদের কব্জায়। সরকারের নীতিকৌশল নির্ধারণে ভূমিকা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এসবের পরও জামায়াতের কেন সরকারের সঙ্গে বিএনপি’র বৈঠক বা সমঝোতা পছন্দ না। বিবৃতির ভাষা দেখে অনেকেই হতবাক হয়েছেন। লন্ডন বৈঠকের পর জামায়াতের মূল্যায়ন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
দলটি বলছে, এতে করে নাকি প্রফেসর ইউনূস নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। বাস্তব অবস্থা কি তাই? জামায়াত বলতে পারতো কী এমন ঘটলো সরকারপ্রধান উল্টো স্রোতে হাঁটতে শুরু করলেন। এক সপ্তাহ আগে যেখানে বিএনপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তাও বিদেশের মাটিতে বসে। বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক দলের মধ্যে শুধু একটি দল নির্বাচন চাইছে।
এ নিয়ে তর্ক হতে পারে এবং হচ্ছে। কিন্তু জামায়াত বিবৃতি দেয়ার মধ্যেই তাদের অবস্থান সীমাবদ্ধ রাখেনি। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক পর্যন্ত বয়কট করেছে। শেষ পর্যন্ত সরকারের ভেতরে জামায়াতের শেয়ারহোল্ডারদের বিরামহীন প্রচেষ্টার পর বুধবার ঐকমত্য কমিশনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ৫ই আগস্টের পর নিষিদ্ধ থাকা দলটি বাংলাদেশি রাজনীতির মূল কেন্দ্রে উঠে আসে। এমনকি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামানের মুখে জামায়াতের নামটি আগে উচ্চারিত হয়। অনেকেই নানা অংক করতে থাকেন।
যদিও পরে জানা গেছে, এটা কোনো কৌশলের অংশ নয়। মুখ দিয়ে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বুলেটের মতো এই দলের নামটি উচ্চারিত হয়েছিল। যেভাবেই দেখা যাক না কেন, এটাও কম প্রাপ্তি ছিল না। এর সুযোগ কিন্তু জামায়াত নিয়েছে পদে পদে। বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্য নিরন্তরভাবে ছুরি চালিয়েছে।
বিশেষ করে চিকিৎসক কাম রাজনীতিবিদ শফিকুর রহমান আলাদা অবস্থান তৈরি করেছিলেন তার বক্তৃতা, বিবৃতি এবং আচরণের মাধ্যমে। এটা ছিল চলমান রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ডা. শফিক একজন সজ্জন ব্যক্তি। জাসদ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন রাজনীতিকের পক্ষে জামায়াতের কাণ্ডারি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
যোগ্যতাবলেই তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক তার বক্তৃতা আর কৌশল দেখে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা বলছেন, এটাই জামায়াত রাজনীতির চিরাচরিত ভুল। দলটি বরাবরই ভুল করে এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না। বিএনপিকে এখন তারা শত্রুর কাফেলায় ঠেলে দিয়েছে। অথচ কে না জানে তাদের জন্য বিএনপিকে গত ১৫ বছরে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া তো শর্ত দিয়ে বসেছিল জামায়াতকে না ছাড়লে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
এখন অবশ্য তারা ভিন্ন মূল্যায়ন করছে। জামায়াতের নেতাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়া ছিল বাংলাদেশি রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। এ নিয়ে অন্তহীন সমালোচনার মুখে পড়েছিল বিএনপি। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, বিএনপি’র সাম্প্রতিক আচরণ জামায়াতকে হতাশ করেছে।
ডা. শফিকুর রহমান নিজেই অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে লন্ডন যান। রাজনীতি নিয়েও তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। অতিথিপরায়ণ তারেক রহমান তার স্বভাবসুলভ আচরণ দিয়ে বৈঠকটিকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। এই বৈঠকের পর বিএনপি’র তরফে কোনো ফলোআপ করা হয়নি। এতেই তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। লন্ডন বৈঠকের পর অতিপ্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দলটি কী লাভ করলো। সমালোচকরা বলছেন, দলটি যতটুকু জায়গা করে নিয়েছিল, ততটুকু জায়গাই হারিয়েছে। বলটা বিএনপি’র কোর্টে ঠেলে দিয়ে দূর থেকে খেলা দেখতে চাইছে। অনেকেই বলেন, এটাই নাকি জামায়াত রাজনীতির বিউটি।
যাই হোক, লন্ডন বৈঠকের পটভূমি কী। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। হিসাব-নিকাশেরও কমতি নেই। হয়তো আরও অনেকদিন চলবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা এক স্মরণীয় এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দেশি-বিদেশি নানা শক্তি এবং ভূ-রাজনীতির কৌশলের অংশ হিসেবেই এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এমনটাই বলা হচ্ছে। যদিও যৌথ বিবৃতি ছাড়া কোনো পক্ষ থেকেই আওয়াজ নেই। লন্ডন বৈঠকেই বাংলাদেশি রাজনীতির সবকিছুর ফয়সালা হয়ে গেছে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
অতীতের মতো যেকোনো সময় চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ উঠতে পারে। ওলট-পালট হতে পারে সবকিছু। তবে, এই বৈঠক স্বৈরাচার ফিরে আসার পথকে আপাতত সিল করে দিয়েছে। বলটা যেহেতু রাজনীতিবিদদের কোর্টে সেজন্য তাদেরকেই বেশি ফাউল না করে খেলাটা শেষ করতে হবে। নাহলে সমূহ বিপদ সামনে অপেক্ষা করছে। হতাশা আরও হতাশার জন্ম দেয়।
বাংলায় একটা কথা চালু আছে- রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। বিএনপি যে ভুল করেনি তা নয়, নিকট অতীতেও অনেক ভুল করেছে। জামায়াত নেতাদের ভুল পরামর্শেই ২০০৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যার মূল্য দিতে হয়েছে অনেকদিন।