
আফজাল হোসেন কায়সার
সাবেক চেয়ারম্যান গাজীপুর সদর উপজেলা
সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি গাজীপুর মহানগর বিএনপি
………………………………………………………………………………………………………….
১৯৭১ সনে পাকিস্তান ভেঙে গেলে নবগঠিত বাংলাদেশে মহা আনন্দে উল্লাস চলছিল আর পশ্চিম পাকিস্তানে শোকের ছায়া চলছিল।পাকিস্তান মিলিটারি কখনো যুদ্ধ হারে না এমন একটা অহংকার ছিলো যাদের – তারক দেখলেন পাকবাহিনীর কেমন শোচনীয় পরাজয় সে যুদ্ধে।১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার জন্ম নেয় তৎকালীন পাকিস্তানে।পশ্চিম পাকিস্তানবাসী বেদনার্ত হয়ে পড়েছিল যুদ্ধে পরাজয় এবং দেশ ভাগে।
১৯৭৪ সাল। তখন সেই মুহুর্তে চলছিল নবগঠিত দেশ- বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ।পথেঘাটে মানুষ অনাহারে পড়েছিল। ছিল শুধু লাশ আর লাশের চারিদিকে গেছে,কাফনের কাপড় জুটছিল না।কলাপাতায় লাশ দাফনের সংবাদ সবাই জানে।প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।বিচলিত হয়ে বিশ্বের দরবারে সাহায্যের আবেদন করলেন।একদিন সেই মুহুর্তে আকাশবাণীর সংবাদ এল_ ভারত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উল্লাসে এবং অহংকারে মাটিতে পড়ছিল না।এমন দুর্ভিক্ষে বাংলার মাটিতে দুমুঠো চাল দিতে তার মন গললো না অথচ পারমাণবিক বোমার বাহাদুরিতে ভারতে নৃত্য চলছিল পথেঘাটে।
আর এদিকে পাকিস্তানবাসী আরও বেদনার্ত হয়ে পরল পারমানবিক শক্তিধর ভারত বুঝি বাকী পাকিস্তান টুকরো টুকরো করে ফেলবে এই আশংকায়। সেই মুহুর্তে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।তিনি প্রচন্ড খেপে গিয়ে জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন_আমরাও পারমানবিক বোমা বানাবো।ভুট্টোর ভাষণ শুনে অনেকেই হাসছিল সেদিন।তবে ভুট্টোকে যাঁরা চেনেন তারা বিশ্বাস করতেন।এই জেদী মানুষটি হয়তো একদিন তেমন কিছু ঘটিয়ে ফেলবেন।
খন্ডিত পাকিস্তানের(পশ্চিম ৬ কোটি মানুষের কান্নার রোল করাচী হতে বালুচিস্তান পর্যন্ত ধ্বনিত হচ্ছিল। কিন্তু না।কিছুদিন যেতে না যেতেই পাকিস্তান জাতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল।বহুদল ও গন্ডগোলের দেশ পাকিস্তানে এবার এক জোত হয়ে যেতে লাগল।ভারতের একটি মাত্র বোমা তাদের হিসাব নিকাশ উল্টে দিল পাকবাহিনীর অঙ্গন।তৎকালীন পাকিস্তানের নেতা ওয়ালী খান,এয়ার মার্শাল, আসগর খান,মিঞা দৌলতানা,গাউস বকস,কাইয়ুম খান,সব দলাদলি ভুলে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করে একত্রে সমর্থন দিয়ে উত্তেজিত করে বললেন যে,যে করেই হোক পারমানবিক বোমা আমাদের বানাতেই হবে।তার জন্য যা প্রয়োজন তাই করুন মিঃ ভুট্টো। মিঃ ভুট্টো তখন পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন_ আমরা অবশ্যই নিউক্লিয়ার বোমা বানাবো।টাকা পয়সা না থাকলে প্রয়োজনে জাতি ঘাস খেয়ে থাকবে,তবুও তা করে ছাড়বো।তারপর বোমা বানানোর গভীর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।যদিও জাতিসংঘের সুপার পাওয়ার গলো হতে প্রচন্ড নিষেধাজ্ঞার বাধা হয়ে ছিল,তবুও ভুট্টো সাহেব পরোয়া করলেন না।পাকিস্তান বোমা বানাবে একথা অনেকটা প্রকাশ্য সংবাদ।পাকিস্তানে শুরু হলো তোড়জোড়।যদিও পারমাণবিক বোমা তৈরি সহজ কাজ নয়।পৃথিবীর বহু শীর্ষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ রয়েছে যারা চেষ্টা করেও বোমা তৈরি করতে পারেনি।এদিকে পৃথিবীর অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন ভারতের বোমা তৈরির মূল প্রযুক্তি রাশিয়ার দেয়া উপহার।যে ভারতের যুদ্ধাস্ত্রের সরঞ্জাম প্রায় শতভাগ রাশিয়া হতে আমাদানি নির্ভর।তাদের আর যাই হোক পারমানবিক বোমা বানানোর সার্থ আর সাধ্য কোনোটাই ছিল না সেই মুহুর্তে। অন্যদিকে বোমা বানানোর যাবতীয় সরঞ্জাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ শুরু হলো পাকিস্তানে।ইতিমধ্যে বিজ্ঞানী আব্দুল কাদের যিনি নেদারল্যান্ডে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে চাকুরিরত ছিলেন তিনি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী।তিনি ছুটি নিয়ে দেশে এলেন।এসেই প্রধানমন্ত্রী ভুট্টাের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।তাঁর পাকিস্তান ভাঙনের কষ্ট এবং বাকি খন্ডিত পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ভুট্টাে সাহেবের কাছে বাচ্চার মতো হু হু করে কাঁদলেন।ভুট্টাে সাহেবও সেই মুহুর্তে অশ্রু সামলাতে পারলেন না।ভুট্টাে সাহেব বললেন,তুমি কি সহায়তা করতে পারবে ভাই পারমাণবিক বোমা তৈরিতে?
বিজ্ঞানী আব্দুল কাদের বললেন_অনেক দিন ধরে পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ করে সকল জ্ঞান আমি অর্জন করেছি।বাকি পাকিস্তান ভারতের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বোমা বানানোর বিকল্প নেই যা আলোচনায় দুজনেই একমত হলেন।ভুট্টাে বললেন_ঠিক আছে তুমি সকল প্রযুক্তি সংগ্রহ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানে চলে এসো।আব্দুল কাদের সানন্দে রাজি হয়ে ফিরে গেলেন নেদারল্যান্ডে।অতঃপর কিছুদিন নেদারল্যান্ডে অবস্থান করে তার সকল প্রযুক্তি সংগ্রহ করে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন আব্দুল কাদের।এসেই সরকারের সকল সহায়তায় পাকিস্তানের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে আব্দুল কাদের দ্রুত কাজে লেগে গেলেন।এবার টাকা জোগাড় করার পালা।
অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত দেশ পাকিস্তান টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছিল।যেহেতু এ কাজে টাকার পাহাড় প্রয়োজন,বুদ্ধিমান ভুট্টাে সাহেব সুকৌশলে মুসলিম দেশগুলোকে বুঝাতে লাগলেন পাঁচ বৃহৎ শক্তি যাদের এই বোমার বাহাদুরি তারা সবাই অমুসলিম দেশ।এই মুহূর্তে মুসলিম দেশগুলোতে পারমাণবিক বোমা তৈরি একান্ত প্রয়োজন।এই মহৎ কাজে আমরা পাকিস্তান ভীষণ আগ্রহী।আপনারা আমাদের অর্থ দিন,আমরা এই কাজটি করবো।এই বোমার নাম হবে ইসলামিক বোমা।এই সুন্দর প্রস্তাবটি মুসলিম বিশ্ব অনেক পছন্দ করলেন।লিবিয়ায় জনপ্রিয় শাসক গাদ্দাফি অতি উচ্চ বিলাসী মানুষ বটে।তিনি এই উদ্যোগে অনেক উৎসাহী হয়ে উঠলেন।তিনি পাকিস্তান সফরে চলে আসলেন একদিন।ভুট্টাে সাহেবও তাকে লাহোরে সুন্দর সম্বর্ধনা গিয়ে প্রখ্যাত লাহোর স্টেডিয়ামের নামকরণ করলেন “গাদ্দাফি স্টেডিয়াম।” মুসলিম দুুনিয়ার জন্য তার মনোভাব পরিষ্কার। মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতার সংগ্রাম পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আর্থিক সহায়তা করে থাকেন।অনেক অবদান রাখেন এউ মুহাম্মদ গাদ্দাফি।তিনি দু’হাত খুলে পাকিস্তানকে অর্থ প্রদান করতে লাগলেন।এদিকে সৌদি বাদশাহ ফয়সালও এগিয়ে এলেন।এমনিভাবে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকলেই পাকিস্তান কে সমর্থন দিতে শুরু করলেন।জুলফিকার আলী ভুট্টোর আর একাজে অর্থের অভাব রইলো না।এবার আর খোলামেলা রইল না।খুবই দ্রুত ও গোপনীয়তার সঙ্গে চলল সকল কর্মকান্ড।অতিদ্রুত ইতিমধ্যে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম এল জেনারেল জিয়াউর হকের নেতৃত্বে।জিয়াউর হকেরও প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলো।তারপর এলো ভুট্টাে কন্যা বেনজির।তারপর এলেন নওয়াজ শরীফের সরকার।অস্থির পাক রাজনীতি টা্মিনাল সেই মুহুর্তে ভারতের রাজনীতিতে এলেন বাজপায়ী আটবানীর নতুন দল। চা বিক্রেতা মুদি ও অন্যতম নেতা বটে।চরম সাম্প্রদায়িক দল এই ভারতের ক্ষমতায় আসায় ভারতবাসী নিজেরাই আতংকিত হয়ে উঠলেন।
অতঃপর আবার সেই ভুল ভারত যেন সর্বনাশের কর্মকান্ডেই আনন্দিত হয়ে উঠলেন।তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী ব্যবসায়ী দিল্লীর রাজভবনে সংবাদ সম্মেলন করলেন। ঘোষণা করলেন_ তারা আবার পারমাণবিক বোমা ফাটিয়েছে পুখায়ার মরুভূমিতে।ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপি পারমাণবিক অংশ নিষিদ্ধকরণ চুক্তি সম্মেলন হয়েছে।বিশ্বের পরাশক্তিসহ সকলেই সেই চুক্তিতে সই করেছে জাতি সংঘের উদ্যোগে।শুধুমাত্র ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরাইল এই চুক্তিতে সই করেনি।যা-ই হোক, পাকিস্তানের যত সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু বোমা তৈরির কাজে সকলেই যত্নবান ছিলেন।বাজপায়ী আটবানী সাহেব যখন ব্যস্ত রয়েছেন মুসলিম নিধন,বাবরী মসজিদ ধ্বংস কর্মকান্ডে তখন পাকিস্তান বোমা তৈরিতে ততোধিক ব্যস্ত।পাকিস্তানের বোমা তৈরির সংবাদ কেউ জানতে পারল না।যেদিন দিল্লীর রাজভবন থেকে সংবাদ সম্মেলন করলেন তার সাত দিনের মধ্যে পাকিস্তান হতে উত্তর পেলেন বাজপায়ী সাহেব,পাকিস্তান একটি নয়,দুটি নয় পাঁচটি পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে দিয়েছিল।যেন এইদিনটির জন্যই পাক বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করেছিলেন।ভারত প্রথমে ঘটনা ঘটাক আমরা তাৎক্ষণিক জবাব দিব।তাই হলো।বিশ্বব্যাপী দেখেশুনে আতংকিত হয়ে উঠলেন কখন কি সর্বনাশ ঘটে যায় উপমহাদেশে। ইতিহাস সাক্ষী দিবো কে এই পারমাণবিক বোমা তৈরিতে পাকিস্তানকে উদ্ভুত করেছে।পাকিস্তানিরা চিরকালই অত্যান্ত সাহসী এবং জিদ্দি জাতি হিসেবে পরিচিত। ভারতের এই বোমা ভীতি সৃষ্টির মনোভাব ছিলো মারাত্মক ভুল।তারাই আগে ভাগে এই ঘটনাটি পাকিস্তানকে অস্ত্র তৈরিতে বাধ্য করেছে।যেন এক প্রকার ঠেলেই দেয়া হয়েছে বোমা বানাতে পাকিস্তানকে।তা না হলে কোনদিনই পাকিস্তান এ পথে হাঁট’তো না বলে বিশ্বাস।