
বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জনাব মাঈন উদ্দিন, প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান, পার্বত্য অধিকার ফোরাম।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’ কনভেনশন ১৬৯ (১৯৮৯) ১ এর (b) এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র- ২০০৭ হলো আদিবাসী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের পাহাড় তিনটি জেলা- খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান বিচ্ছিন্ন করার চাবিকাঠি।
২০০৭ ঘোষণাপত্রে ৪৬টি অনুচ্ছেদ আছে, এখানে এমন কিছু অনুচ্ছেদ আছে, যেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি রাস্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি:
(ক) অনুচ্ছেদ-৩: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।
(খ) অনুচ্ছেদ-৪: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।
(গ) অনুচ্ছেদ-৫: আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।
(ঘ) অনুচ্ছেদ-৬: আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।
৫। উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশে থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
এই ঘোষণাপত্রের পর থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উপজাতি পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে এবং আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এ দেশের মানুষের কাছে উপজাতি এবং আদিবাসী শব্দ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই আদিবাসী শব্দটি প্রচণ্ড বেখেয়ালি।
আমার ধারণা এই দেশের ৯৯% মানুষ উপজাতি এবং আদিবাসী শব্দের তফাত বুঝে না। উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে কী সমস্যা তৈরি হবে তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
একবার আদিবাসী স্বীকৃতি দিয়ে দেখুন, পরে দেখবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মত রাস্ট্র গঠন হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পাহাড়ে অন্তত ৬টি বিচ্ছিন্নতাবাদী অস্ত্রধারী উপজাতি সংগঠন সক্রিয়। যাদের হাতে এমন সব অস্ত্র আছে যা রাস্ট্রীয় বাহিনী হাতে নেই। পাহাড়ের ঘরে ঘরে একে-৪৭ অস্ত্র, এম-১৬ অস্ত্র, রকেট লাঞ্চার সহ ভয়ংকর মারণাস্ত্র রয়েছে। ভারত, মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হাতে আসে। এদের অস্ত্র ক্রয় উৎস এনজিও, দাতাসংস্থা এবং চাঁদাবাজি।
আমরা কেন উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিরোধিতা করি? কারণ এই শব্দের স্পর্শকাতর আদিবাসী শব্দ বাস্তবায়িত হলে পাহাড় থেকে বাঙালি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে নিতে হবে একইভাবে এ অঞ্চলে রাস্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ দেশের মানুষ যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগবে। পার্বত্য উপজাতিরা এ দেশের আদিবাসী নয়, তারা রোহিঙ্গাদের মত শরণার্থী হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করে। যথাক্রমে তারা এখন নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করছে আর বাঙালিদের সেটেলার দাবি করছে। জাতিসংঘে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়, তারপরও জাতিসংঘের আইএলও সংজ্ঞা সকলের বুঝার সুবিধার্থে তুলে ধরছ:
ILO Convention No-169, প্রথম পার্ট 1- ধারার (A) তে বলা হয়েছে-
“স্বাধীন দেশের উপজাতীয় জনগণ যাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তাদেরকে জাতীয় সম্প্রদায়ের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি বা ঐতিহ্য বা বিশেষ আইন বা প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; মূলত তারাই উপজাতি।”
ILO Convention No-169, প্রথম পার্ট 1- (B) তে বলা হয়েছে-
“স্বাধীন দেশের জনগণ যারা বিজয় বা উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ব বা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিষ্ঠার সময় দেশটিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা বা দেশটির অন্তর্গত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে তাদের বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে আদিবাসী হিসাবে বিবেচিত হয় এবং যারা, তাদের আইনগত অবস্থা নির্বিশেষে, তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কিছু বা সমস্ত বজায় রাখে তারা মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠী।”
(A), (B) দুটি ধারা থেকে আমরা জানতে পেরেছি উপজাতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্ণয় বা নির্ধারণের সংজ্ঞা।
আমাদের বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ কেবল (a) শর্তাবলির পূরণ করে তারা কিন্তু (b) আদিবাসী শর্তাবলি পূরণ করে না।
এর বাহিরে প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুই মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’
এই উপজাতিদের এ দেশে বসবাস ইতিহাস ৩০০ বছরের বেশি নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা কি নিজেদের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করতে পারে? একসময় উপজাতিরা নিজেদের উপজাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। উপজাতি কোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি এবং চাকরি করতো। এখনও করে। চুক্তির সময় তারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে স্বাক্ষর করেছে (জেএসএস)। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি, লুসাই, চাক, মুরং প্রভূতি নামে পরিচিত ছিল সবচেয়ে উত্তম পরিচয় এবং সমষ্টিগতভাবে উপজাতি। ভাষা, সংস্কৃতি, বসবাসের ইতিহাস বিবেচনায় এবং নৃতাত্ত্বিক বিচারেও উপজাতি। আজকের উপজাতি নেতৃত্ব বা দলরা ব্রিটিশদের প্রথাগত আইন মানে কিন্তু তাদের আইনের উপজাতি মানে না! পার্বত্য চট্টগ্রাম রেজুলেশন (প্রথাগত আইন) ৫২ ধারায় বাংলাদেশে উপজাতিরা অভিবাসী হিসেবে স্বীকৃত! ব্রিটিশরা কখনও তাদের শরণার্থীর বাহিরে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ সংবিধান উপজাতি ২৩ (ক) উপজাতি হিসেবে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশের মত আরাম আয়েশে পৃথিবীর আর কোথাও উপজাতিরা এত এতো সুবিধা ভোগ করে না। বাংলাদেশ থেকে কি কেউ তাদেরকে দৌড়াচ্ছে? তাদের অধিকারে কি কেউ হস্তক্ষেপ করছে? কেন আজ তারা নব্য আদিবাসী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? নিশ্চয়ই এখানে তাদের এমন কোনো বিশেষ স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
এখন তারা যা করছে এসব কিছুতে সহযোগিতা করছে শাহবাগী- বাম, সুশীল কথিত বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র ইউনিয়নের মত পরগাছা। এমনও স্বার্থ আছে, যেখানে তারা লাভবান।
শাহবাগী আর উগ্র উপজাতিরা কোনো ধর্ম, আইন, যুক্তি মানে না। এদের মতের বিরুদ্ধে গেলে গালমন্দ করে। খুবই উগ্র টাইপের কথাবার্তা বলে। তাদের কাছে প্রশ্ন এই প্রশ্ন থাকলো-
ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন প্রথম বসবাসকারী। কারণ এখানে রোহিঙ্গাদের আগে মানববসতি ছিল না। যেহেতু ভাসানচরে বাঙালি নেই এই বিচারে কিন্তু রোহিঙ্গারা আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে। এখন কী আপনি রোহিঙ্গাদের এ দেশের আদিবাসী হিসেবে অর্থাৎ ভূমিপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিবেন? তাদের জন্য আন্দোলন বা গলা ফাটাবেন? যদি রোহিঙ্গাদের আদিবাসী হিসেবে মেনে নিতে পারেন, তাহলে আমার সমস্যা নেই। রোহিঙ্গাদের মত বার্মা, ভারত, মঙ্গোলীয় ও তিব্বত থেকে শরণার্থী হিসেবে পাহাড়ে বসবাস করা উপজাতিরা এ দেশে আদিবাসী হলে আপনার মত আমারও আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু যদি রোহিঙ্গাদের যদি আদিবাসী বলতে আপত্তি থাকে তাহলে উপজাতিদের এ দেশে আদিবাসী বলতে আমার যথার্থ আপত্তি আছে।
সরকার এই বর্বর, অকৃতজ্ঞ ও দেশদ্রোহী উপজাতিদের থামানোর জন্য ১৯৯৭ সালে ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত করে। কোনো বাংলাদেশি সুস্থ জ্ঞানের মানুষ যদি পার্বত্য চুক্তি পড়ে তাহলে সে জীবনে আর উপজাতিদের অধিকার প্রশ্নে কথা বলবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা প্রদেশের মত হয়ে গেছে। চুক্তির মাধ্যমে উপজাতিরা অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা এখনো অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ আর বাঙালি হত্যা করে। পার্বত্য এলাকায় প্রতিনিয়ত বাঙালি ও সরকারি বাহিনী উপজাতি জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ এর মত সংগঠনের হাতে হামলা, মামলা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়ে আসছে। সেখানে এই বর্বর, দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে গ্রহণ করা রাস্ট্রের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।
তথ্য বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহীত।