
আয় ফেরত আনার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নেট ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮.৮ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১.৬১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেট এফডিআই প্রবাহ ১.৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই প্রবাহ ১৪২ মিলিয়ন ডলার কমেছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয় এফডিআই কমার জন্য তিনটি প্রধান কারণকে দায়ী করেছেন।
এজাজ বলেন, প্রথমত, নির্বাচনী বছরের প্রভাব। নির্বাচনী বছরগুলোতে সাধারণত এফডিআই প্রবাহে ধীরগতি দেখা দেয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ প্রবণতা বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ডলার সংকট কিছুটা কমলেও মুদ্রার অবমূল্যায়নসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ‘অপেক্ষা করে দেখি’ কৌশল অনুসরণ করছেন।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ, দেশের ক্রেডিট রেটিং কমে আসা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ক্রেডিট রেটিংয়ে অবনতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। কারণ এর ফলে বিনিয়োগের ঝুঁকি আছে, এমন মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, সাম্প্রতিক ক্রেডিট রেটিং কমে আসার ফলে বাংলাদেশের এফডিআই আরও কমতে পারে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রেটিং স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক পর্যায়ে নামিয়ে আনে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের দুর্বল তারল্য এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট নীতিগত ঝুঁকি।
মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস-ও এই বছরের মে মাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রেটিং ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১1’-এ নামিয়ে এনেছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রেখেছে, যা অর্থনীতির ঋণ সক্ষমতায় কোনো তাৎক্ষণিক ঝুঁকি নেই বলে ইঙ্গিত করে।
এফডিআই প্রবাহে এই ধীরগতি ডলার বিনিময় হারেও প্রভাব ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাইয মাসে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৮.৪০ টাকা। এটি ২০২৪ সালের জুন মাসে বেড়ে ১২১ টাকায় পৌঁছেছে, অর্থাৎ ১০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার রেটিং কমে এলে সেটি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি জানান, বিনিয়োগকারীরা এসব রেটিংকে গুরুত্বের সেঙ্গে বিবেচনা করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব রেটিংয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ ধরনের রেটিং অর্থনীতির আপেক্ষিক শক্তিমত্তাকে প্রতিফলিত করে এবং নিম্নমানের রেটিং বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মোট নেট এফডিআই-এর মধ্যে ৬১৫ মিলিয়ন ডলার ছিল পুনঃবিনিয়োগিত মুনাফা। আরও জানা যায়, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের নেট এফডিআই-এর ৪২ শতাংশ পুনঃবিনিয়োগিত মুনাফা থেকে এসেছে। অর্থাৎ দেশের এফডিআই প্রবাহের একটি বড় অংশ বিদ্যমান বিদেশি বিনিয়োগের মুনাফা পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে এসেছে।
কেন পুনঃবিনিয়োগিত মুনাফা এফডিআই-এর একটি বড় অংশ- এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ওপর রিটার্ন বা লাভ খুবই আকর্ষণীয়। এটি অনেক বিনিয়োগকারীকে তাদের মুনাফা পুনঃবিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে।
তিনি বলেন, তবে ডলার সংকটসহ আয় ফেরত আনতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় তাদের আয় না তুলে পুনঃবিনিয়োগে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বাধিক ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে। তারপর, ব্যাংকিং খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম এবং খাদ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ দেখা গেছে।