
দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রাচীন সভ্যতা। ধারণা করা হয় ইনকা সভ্যতার মানুষ, আমেরিকার অন্যান্য জাতির লোকদের মতই, বেরিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে, আমেরিকা মহাদেশে পা রেখেছিল। কালক্রমে নানাভাগে বিভক্ত হয়ে, এরা আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে।
ইনকা সম্রাজ্যের ইতিহাস
১১০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এদের একটি দল দক্ষিণ আমেরিকার অন্দিজ পর্বতমালার পেরুর উচ্চভূমির দিকে চলে আসে এবং এখানকার কুজবেন নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। স্থানের নামানুসারে এদেরকে বলা হয় কেচুয়া জাতি। এরা এই অঞ্চলে জঙ্গল কেটে কৃষিভূমি উদ্ধার করে এবং চাষাবাদ করতে থেকে। এদের অন্যতম ফসল ছিল ভুট্টা এবং আলু। প্রাথমিক অবস্থায় এই জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে একটি রাজত্ব গড়ে তোলে। কুজবেনে বসবাসের সময় এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে এদের বসবাসের এলাকা বৃদ্ধি পায়। এই সময় অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে কিছু যুদ্ধবিগ্রহ হলে, এরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই জয়ী হয়। এই সকল যুদ্ধের সূত্রে এদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা সমাজে সম্মানিত এবং ক্ষমতাধর হয়ে উঠে। এরপর এই সকল যোদ্ধাদের সমর্থনে কেন্দ্রীয় নেতার উদ্ভব হয়েছিল ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগেই। ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই ব্যক্তি কাপাক (capac) নামে অভিহিত হতে থাকে। উল্লেখ্য ইনকাদের ভাষায় কাপাক শব্দের অর্থ শাসক।

ইনকা ইতিহাসে মান্কো কাপাক (Manco Capac)-কে প্রথম রাজা বা সম্রাটের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইনকা সমাজের রীতি অনুসারে, মান্কো তাঁর নিজের বোনকে বিবাহ করেছিলেন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি কুজ্কো (Cuzco) নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়, মান্কো কাপাকের উত্তরসূরীরা ছোটো ছোটো রাজাদের রাজ্য জয় করে রাজ্যের বিস্তার ঘটায়।
এই রাজবংশের পাচুকুটি (Pachacuti), ইনকা রাজ্যকে সম্প্রসারিত করে প্রথম একটি সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। যতদূর জানা যায়, ১৪৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পাচুকুটি ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। সাম্রাজ্যের অধিকার লাভের পরপরই কুজকোর তিনি করিক্যাঞ্চা (Coricancha) নামক স্থানটি নতুনভাবে সাজান। তাঁর সময়ে তৈরি কুজকো থেকে ৫০ মাইল দূরে ওল্লান্টায়টাম্বো (Ollantaytambo) নগরী। তবে তাঁর সময়ে তৈরি সবচেয়ে আলোচিত নগরী হলো মাচুপিচু (Machu Picchu)। সম্ভবত ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পাচুকুটি মাচুপিচু নগরী তৈরি করেছিলেন। এই নগরীটি কেন তৈরি করেছিলেন, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। অনেকে মনে করেন মাচুপিচু নগরীটি ছিল সম্রাটের নিজস্ব সম্পদ। এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া শীতকালীন রাজধানী হিসেবে নগরীটি ব্যবহার করা হতো। উল্লেখ্য, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাইরাম বিংহাম ((Hiram Bingham) ‘মাচুপিচু’ নামক শহরটির সন্ধান পান। এই নগরীটি স্প্যানিশদের হাত থেকে বিস্ময়করভাবে রক্ষা পেয়েছিল।
পাচাকুটিকে সম্রাট হিসেবে লোকে মান্য করার চেয়ে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বেশি মান্য করতো। ধারণা করা হয়, তার সময় থেকেই সাধারণ মানুষ সম্রাটকে দেবতার অংশ হিসেবে মান্য করা শুরু করে। পাচুকুটির রাজত্বকালে ইনকা সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যে বিস্তারের প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল, পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখলের মধ্য দিয়ে। এই সময় বিজিত রাজ্যের শাসক যদি ইনকা সম্রাটের আনুগত্য মেনে নিত, তাহলে, তাকে হত্যা করার পরিবর্তে শাসনের অধিকার দেওয়া হতো। মূলত এই প্রক্রিয়ায় ইনকা সাম্রজ্যের বিশাল অংশ ছিল করদ রাজ্য হিসেবে। বর্তমান ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়া ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাচুকুটির রাজত্বকালে সব মিলিয়ে ইনকা সাম্রাজ্য প্রায় দুই হাজার পাঁচশ মাইল বিস্তৃত ছিল। এই সময় ইনকারা নিজেদের সাম্রাজ্যের নাম দিয়েছিল ‘তাহুয়ানতিনসুইউ’ (চতুষ্কোণ ভূমি)।
১৪৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাচুকুটির মৃত্যুর পর সম্রাট হন টোপা ইনকা (Topa Inca)। তিনি তাঁর আপন বোন মামা ওক্ক্লো (Mama Occlo) বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁর প্রধান স্ত্রীও ছিলেন মামা। টোপা ইনকা-কে ইনকার অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী মানুষ মনে করতো। পাচুকুটির সময়, সম্রাট দেবতাদের অংশ এই ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। টোপা ইনকা-এর প্রতি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সে ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর সময়ে তৈরি হয়েছিল চিন্চেরো (Chinchero) এবং চোকুকুইরাও (Choquequirao) রাজকীয় নগরী তৈরি হয়।
১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে টোপা ইনকার মৃত্যু হলে, তাঁর উত্তরসূরী হুয়াইনা কাপাক (Huayna Capac) সম্রাট হন। এই সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যকে সুসংহত এবং শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁর আমলে ইনকা সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর সময়ে তৈরি হয়েছিল কুয়েসপিওয়ান্কা (Quespiwanka) এবং টোম্বেবাম্বা (Tombebamba) নগরী। ১৫২৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্যারাগুয়ে থেকে চিরিউয়ানো গোষ্ঠীর সৈন্যরা পর্তুগিজ দখলদার আলিক্সো গার্সিয়াকে নিয়ে ইনকা রাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণ ইনকা সৈন্যরা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে। কিন্তু ইউরোপীয় সৈন্যদের দ্বারা সিফিলিস, বসন্ত রোগ এবং পেটের রোগ, জ্বর ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা এরা আক্রান্ত হয়। এই জাতীয় রোগের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ইনকাদের ছিল না। ফলে এই সকল রোগ দ্বারা বহু লোকের মৃত্যু হয়। কোনো একসময় এই জাতীয় রোগে ওয়াইনা কাপাক-এর রাজ পরিবারও আক্রান্ত হয়। ধারণা করা হয় সম্রাট ওয়াইনা কাপাক এবং তাঁর পরিবারের বহুলোকের মৃত্যু ঘটেছিল। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াইনা কাপাকের মৃত্যুর পর, কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়া তার দুই ছেলের ভিতরে হুয়াসকার (Huascar) রাজ্য লাভ করেন। কিন্তু তাঁর অপর ভাই আটাহুয়ালপাও (Atahuallpa) সিংহাসনের অধিকার দাবী করেন। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে হুয়াসকারকে অপসারিত করে আটাহুয়ালপা সম্রাট হন। আত্মকলহের কারণে এই সময় ইনকা রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই বছরেই আটাহুয়ালপা-কে হত্যা করে স্প্যানিশ লুটেরা বাহিনীর নেতা ফ্রানসিসকো পিজারো পেরুর উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

ইনকা সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় স্প্যানিশ ফ্রানসিসকো পিজারোকে। পিজারো স্পেন থেকে ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে হিসপানিওয়ালা (বর্তমানকালে হাইতি ও ডোমেনিকান রিপাবলিক) দ্বীপে আসেন। ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে কলোম্বিয়া অভিযানে অংশ নেন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি পানামা পৌঁছান। এখানে এসে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ ভূখণ্ডের কথা জানতে পারে। ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পরপর দুটো অভিযান চালান। এই সময় তিনি ইনকাদের সাম্রাজ্যের প্রবেশ করেন। তিনি ষড়যন্ত্র করে কিছু ইনকা জাতির লোককে বন্দী করেন এবং সেই সাথে প্রচুর সোনাদানা এবং লামা নিয়ে স্পেনে ফিরে আসেন। এরপর পিজারো স্পেনের তৎকালীন রাজা পঞ্চম চার্লস-এর কাছে পেরু দখল এবং সেখানকার শাসক হওয়ার অনুমতি চান। রাজা পঞ্চম চার্লস পিজারোকে এই অভিযানে অনুমতি দেন । ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বর্তমান পেরুতে পৌঁছান। ১৭৭ জন সৈন্য ও ৬২টি ঘোড়া নিয়ে কাজামারকা শহরে যাত্রা করেন। সে সময়ের ইনকা সম্রাট তখন আটাহুয়ালপা কাজামারকা শহরে অবস্থান করছিলেন। পিজারো কাজামারকা শহরের কাছে এসে ইনকা সম্রাটের কাছে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা অনুমতি প্রার্থনা করেন। সম্রাট তাঁকে ঘোরাফেরার অনুমতি দিলে, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর তিনি শহরে প্রবেশ করেন। ১৬ই নভেম্বর তিনি শহরের একটি খোলা জায়গায় আটাহুয়ালপা ও ইনকা অভিজাতদের ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। ইনকা সম্রাট এবং অভিজাত শ্রেণির লোকেরা সরল বিশ্বাসে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আসেন। এরপর স্প্যানিশ সৈন্যরা তাঁদের ঘিরে ফেলেন এবং সম্রাট ছাড়া সকল অতিথিদেরকে হত্যা করে। এরপর পিজারো সম্রাটের মুক্তি পণ হিসেবে এক ঘর ভর্তি সোনা আর দুটি ঘর ভর্তি রূপা দাবী করেন। রাজ্যের অভিজাতরা পিজারোর সেই দাবী মেনে নেওয়ার পরও সম্রাটকে হত্যা করেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর ইনকাদের প্রতিরোধ করার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, পিজারো ইনকার রাজধানী কুজকো দখল করে নেয়। ইনকা সাম্রাজ্যে স্প্যানিশদের দখলে আসার পর, এরা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে হত্যা, লুণ্ঠনের তাণ্ডব চালায়। ইনকাদেরকে দাস হিসেবে বিক্রয়ের কার্যক্রম চালায়। পুরো পেরু অঞ্চল দখলে আসার পর, ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পিজারো লিমা নামে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে এবং এই শহরে রাজধানী স্থাপন করে, পেরু শাসন করা শুরু করে।
এই সময় কৌশলী পিজারো, সম্রাট আটাহুয়ালপা-কে হত্যা করলেও, তার আরেক ভাই মানকো কাপাককে সিংহাসনে বসায়। ইতিমধ্যে লুটেরা স্প্যানিশদের মধ্যে স্বর্ণরৌপ্যের ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গামা বাধে। মানকো তাদের এই হানাহানির সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভিলকা বাম্বায় আশ্রয় নেয় এবং নতুন রাজধানী পত্তন করে। ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে পিজারো ৬৬ বছর বয়সে লিমায় নিজ প্রাসাদে খুন হন।
মানকো কাপাক ভিলকা বাম্বায় থেকে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে গুপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা করা শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই যুদ্ধ চলার পরও স্প্যানিশরা ভিলকা বাম্বার অবস্থানই জানতে পারে নি। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্প্যানীয়রা ভিলকা বাম্বার অবস্থান খুজেঁ পায় এবং মানকো-কে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মূলত এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ইনকা সম্রাট ও তার সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।