
দেশের শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের চুক্তির মূল্যের ৬১.৩১ শতাংশ কাজ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের দখলে। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারিত্ব সব মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ শতাংশের কম।
আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার এবং রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য : একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংস্থাটি ২০১২-২০২৪ সময়কালে দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মোট ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৪ টি ক্রয়কার্যের তথ্য বিশ্লেষণ করে। ২০১১ সালে চালু হওয়ার পর থেকে, বাংলাদেশ ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এই পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত চুক্তির মূল্য ৮৮১ কোটি টাকা। এর চেয়ে বেশি মূল্যের সব চুক্তি এই প্ল্যাটফর্মের বাইরে রয়েছে।
টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদন আরও বলছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার এক দশকে তাদের বাজার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭৪.৯৬ শতাংশ কাজ করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ঠিকাদারদের দখল ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যতম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এছাড়া, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার উচ্চপর্যায়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিবর্তনে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাত বদল হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। টিআইবি এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকারি ক্রয়ে সুশাসন নিশ্চিতে ছয় দফা সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি ক্রয়খাত সারাবিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ, তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারিত্বের হাতে জিম্মি দশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য মোট ক্রয় বাজেটের ২৭ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। প্রত্যাশা ছিল, ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে, সরকারি ক্রয়খাতে দুর্নীতি কমবে এবং ব্যয়িত অর্থের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি বরং ইলেক্ট্রনিক ক্রয় ব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার এবং রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি সরকারি ক্রয়খাতে ব্যয় করেছে শীর্ষ ১০টি মন্ত্রণালয়। যার সিংহভাগ, ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ পেয়েছে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এই কার্যাদেশ প্রাপ্তির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এখানে বাজারের বিশাল অংশ প্রভাবশালী ঠিকাদারদের দখলে।
দ্বিতীয়ত, একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র নীতিমালার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যৌথ অংশীদারত্ব বা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কার্যাদেশ নেওয়ার সুযোগকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করেছে ও দখলদারিত্ব আরো ঘনীভূত করেছে।
আবার, ই-জিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাত বদল হয়েছে কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থেকেছে। যা ক্রয়খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অকাট্য প্রমাণ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদ পরবর্তী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি-না— এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তব সুফল অর্জন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও চর্চায় ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া অসম্ভব।’