
অন্তত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকায় এসব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে কমিশন। এগুলো হচ্ছে, ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের ঘটনার সাথে জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোন আইনি সুরক্ষা না দেয়া। গুমে অংশ নিয়েছে একাধিক বাহিনী কিন্তু পরিচয় দিয়েছে অন্য বাহিনীর।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে বীভৎস নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে। সাদা পোশাকধারী কয়েক জন ব্যক্তি ধানমন্ডি এলাকা থেকে এক যুবককে তুলে নিয়ে তার ঠোঁট অবশ করা ছাড়াই সেলাই করে দেয়। একজন ব্যক্তিকে আটক করে যৌনাঙ্গ এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। অন্য আরেক ঘটনায় এক ভিকটিম নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে সেখানেই হত্যা করা হয়। এমনকি হত্যার পর সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে লাশ নদীতে ফেলা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুম করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে।
গত শনিবার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুম সম্পর্কিত তদন্ত কমিশন। সেই প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। সেখানে গুম ও নির্যাতনের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কমিশন বলছে, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। বিশেষ করে ভারতীয়দের জড়িত থাকার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে অপহৃত সুখরঞ্জন বালি এবং উত্তরা থেকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের দুই জনকে বাংলাদেশে আটক করা হলেও তাদের সীমান্তের ওপারে পাঠানো হয়। এছাড়া বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হাম্মাম কাদের চৌধুরী তার বন্দিশালায় হিন্দি ভাষাভাষীলোকদের কথা শোনার কথা কমিশনকে জানিয়েছেন। তার দাবি মুক্তির সময় তাকে বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, তবে কিছু শর্ত এখানে রয়েছে। আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হবে এবং দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে।’
‘একটি লাশ নিয়ে ঢাকার রেললাইনের ওপরে রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করতে বলা হয় যেন ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি আরেক ভুক্তভোগীকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হলেও গাড়িটি পাশ কেটে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।’ একজন সাক্ষী এক সেনা সদস্যের বরাত দিয়ে কমিশনকে এমন তথ্য জানিয়েছেন।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ। অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি অভিযোগে অন্তত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকায় এসব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে কমিশন। সেগুলো হলো ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া। অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা ও মুক্তি এই পাঁচটি ভাগে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল উপায়ে গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
গুম করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি :প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাউকে গুম করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় প্রথমে কাউকে আটক করে নির্যাতন করে অন্যদের নাম আদায় করা হতো। এরপর তাদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। পরে এদের সবাইকে গুম করা হতো। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সরাসরি নির্দেশেও গুম ও নির্যাতন করা হতো। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার সময় তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদের স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং পরে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইল নজরদারি পরিচালনা করেছে বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে।
১৫ বছরের গুমের পর্যালোচনা
বছর | অভিযোগ | বছর | অভিযোগ |
---|---|---|---|
২০০৯ | ৫ | ২০১৭ | ৮৪ |
২০১০ | ১৯ | ২০১৮ | ৮৯ |
২০১১ | ২৩ | ২০১৯ | ৩৬ |
২০১২ | ৩৬ | ২০২০ | ১৮ |
২০১৩ | ৭৩ | ২০২১ | ২৫ |
২০১৪ | ৪৫ | ২০২২ | ৪২ |
২০১৫ | ৭৮ | ২০২৩ | ৩৪ |
২০১৬ | ১৩০ | ২০২৪ | ২১ |
অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং মুক্তি
অপহরণ
অনুসন্ধান অনুসারে, অপহরণ সাধারণত রাস্তায় বা বাড়িতে সংঘটিত হত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতে। অপহরণকারীরা প্রায়ই সাদাপোশাক পরিহিত থাকত এবং নিজেদের পরিচয় দিত ‘প্রশাসনের লোক’, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ডিবি অথবা র্যাব হিসেবে। যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা গভীর মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন, কারণ তাঁরা দেখেছিলেন কীভাবে তাঁদের প্রিয়জনদের মারধর করে ও জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে, অপহৃতদের আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া, ফেরি, রাস্তার পাশ, অথবা অন্যান্য জনবহুল স্থান থেকেও ভুক্তভোগীদের অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণের সময় তাঁদের নাম ধরে ডাকা হতো এবং দ্রুত বড় গাড়িতে তুলে নেওয়া হতো। গাড়ির ভেতরেই ভুক্তভোগীদের চোখ বাঁধা, হাতকড়া পরানো এবং অস্ত্রের মুখে হুমকি দেওয়া হতো। প্রায়শই, নির্যাতন, যেমন: মারধর বা বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, আটকের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যেত।
কিছু অপহরণ জনসমক্ষে ঘটেছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত স্থানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াই অপহরণ সংঘটিত হয়েছে, যার ফলে প্রমাণ সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ভুক্তভোগী, যিনি বেঁচে ফিরে এসেছিলেন, উল্লেখ করেছেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে চা খেয়েছিলাম এবং সে বাড়ি ফিরছিল। পনেরো মিনিট পরে আমি রাস্তার পাশে তাঁর সাইকেল এবং বই পড়ে থাকতে দেখলাম।’
যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের সাক্ষ্য এবং পরিস্থিতির ভিত্তিতে কিছু অপহরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
আটক
ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সময়ের জন্য আটক রাখা হত–৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা, কয়েক সপ্তাহ বা মাস এবং কিছু ক্ষেত্রে আট বছর পর্যন্ত। সাধারণ ধারণা ছিল যে ভুক্তভোগীদের কেবল গোপন কারাগারে রাখা হয়, কিন্তু বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, অনেককে বৈধ বন্দীদের সঙ্গে একই সেলে আটক রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, একই স্থাপনার ভেতরেই তাঁদের অবৈধ সেল থেকে বৈধ সেলে স্থানান্তর করা হতো। এসব স্থানান্তর সাধারণত আদালতে হাজিরার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হতো, যেন তাঁদের অবৈধ আটকের বিষয়টি আড়াল করা যায়।
তদন্তে দেখা গেছে, অনেক গোপন আটককেন্দ্র এখনো অক্ষত রয়েছে, যদিও কিছু ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসগুলো পরিদর্শনের সময় এসব কেন্দ্রে আটক ব্যক্তিদের অবস্থান নির্ধারণে ভুক্তভোগীদের বিবরণ কাজে লাগিয়েছে কমিশন।
নির্যাতন
নথিভুক্ত নির্যাতনের বর্ণনা নির্মম এবং পদ্ধতিগত। বেসামরিক বাহিনীর (যেমন: ডিবি বা সিটিটিসি) পরিচালিত কেন্দ্রগুলোতে নির্যাতন তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ ছিল। এসব নির্যাতন স্থানীয় অফিসেই ঘটত এবং প্রায়শই বিশেষায়িত সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো।
অন্যদিকে, সামরিক বাহিনী (যেমন র্যাব বা ডিজিএফআই) পরিচালিত কেন্দ্রে নির্যাতনের জন্য বিশেষায়িত অবকাঠামো ছিল। এসব কেন্দ্র প্রায়ই সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং বিশেষ যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত ছিল। এগুলো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
এক ভুক্তভোগী উল্লেখ করেছেন, ২০১০ সালে তাঁকে ধানমন্ডি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার ঠোঁট সেলাই করা হয়েছিল, কোনো অ্যানাস্থেটিক ব্যবহার (অবশ) না করেই। তিনি এই অভিজ্ঞতাকে ‘গরুর চামড়া সেলাই করার মতো’ বলে বর্ণনা করেছেন।
হত্যা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের হয় হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে আটকে রাখা হয়েছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের মরদেহ সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে, সামরিক কর্মকর্তা এবং সৈন্যরা সরাসরি এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, এক র্যাব কর্মকর্তা বর্ণনা করেছেন কীভাবে একটি ‘অভিষেক’ সেশনের সময় তাঁর সামনে দুটি ভুক্তভোগীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তি
যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁরা কমিশনের তদন্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস। তবে মুক্তি পাওয়া ভুক্তভোগীদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে এবং তাদের নির্যাতনের বিষয়টি ঢাকতে মিডিয়ায় মিথ্যা গল্প প্রচার করা হয়েছে।
বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সাক্ষ্য অনুসারে, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এবং স্থানীয় আইন ও বিচারব্যবস্থার ফাঁদে ফেলে দীর্ঘ সময় ভোগান্তির শিকার করা হয়েছে।