
আসন্ন ভরা মৌসুমের বাজার ধরতে দম ফেলার ফুরসত নেই ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী এলাকার ফুলচাষিদের। গ্রীষ্ম-বর্ষার বৈরিতা পেরিয়ে শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় সুদিনের স্বপ্ন বুনছেন এই অঞ্চলের সাত হাজার ফুলচাষি। এই মৌসুমের বিভিন্ন দিবস ঘিরে শত কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্যের আশা করছেন তারা।
কৃষি বিভাগ বলছে, আবহাওয়ার এই অনুকূল পরিবেশ এবং বাজার ভালো হলে প্রত্যাশা পূরণ হবে কৃষকদের।
দু’চোখ যত দূর যায়, শুধু ফুল আর ফুল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ফুলের সুবাস যেন মন ভরিয়ে দেয়। ফুলের ঘ্রাণে ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতোই গদখালী। এটি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার একটি ইউনিয়ন। ফুলের জন্য মানুষ আসছে। কেউ ক্রেতা আবার কেউ দর্শক। বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাজার ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর ফুল চাষিরা। তাদের আশা, এ তিন দিবসে অন্তত শতকোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।
ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী অঞ্চলে ফুলচাষিদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। অধিকাংশ কৃষক তাদের ফুলক্ষেতে পুরো মাত্রায় পরিচর্যা করে চলেছেন। এই অঞ্চলে বছরজুড়ে ফুলচাষ হলেও ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচমাস ফুলের ভরা মৌসুম। সাধারণত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, মহান বিজয় দিবস, খ্রিস্টিয় নববর্ষ, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশে ফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর এসব দিবসকে টার্গেট করে গদখালীর চাষিরা ফুল আবাদ করে থাকেন। চলতি বছরের গ্রীষ্মে অতি তাপমাত্রা আর বর্ষার অতিবৃষ্টির ধকল কাটিয়ে এবার মৌসুমে চাষিরা শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির স্বপ্ন বুনছেন।
পুরো গদখালী অঞ্চল সেজেছে ফুলের সাজে। মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফুল। ফুলের রাজধানী যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা ও আশপাশের এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গাঁদা, লিলিয়াম, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল। চলতি মৌসুমে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফুলের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবু আসন্ন বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাজার সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন ফুল চাষিরা। উৎসব পর্যন্ত ফুল ধরে রাখতে, পোকার আক্রমণ ও পচন রোধে করছেন পরিচর্যা।
ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের সৈয়দপাড়ার ফুলচাষি শাহজাহান কবীর বলেন, ‘আমি ৫ বিঘা জমিতে গাঁদা ও ২ বিঘাতে রজনীগন্ধা চাষ করেছি। ভালোবাসা দিবসে রজনীগন্ধা ও ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে গাদা ফুল বিক্রি করব। এজন্য এখন ফুলের পরিচর্যা করছি। বিশেষ করে ফুল ধরে রাখতে এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে ভিটামিন ও কীটনাশক ব্যবহার করছি। আশা করছি, ভালো দামে ফুল বিক্রি করতে পারব।’
একই গ্রামের ফুলচাষি আহম্মদ আলী বলেন, ‘আমার ২ বিঘা ৪ কাঠা গোলাপ বাগান রয়েছে। আমার বাগানের গোলাপগুলো লংস্টিক এবং লাল, সাদা, হলুদ, কমলা ও গোলাপি রঙের। ভালোবাসা দিবসে এ ধরনের ফুলের বেশ চাহিদা থাকে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। গাছে এখন নতুন কুড়ি বেরিয়েছে। এগুলো যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য ভিটামিন স্প্রে করছি। ভালোবাসা দিবসের আগেই ফুলের দাম বাড়বে। আশা করছি, একেকটি গোলাপের পাইকারি দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে পাব।’
পানিসারা গ্রামের আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা যারা ফুলের চাষ করি, তারা উৎসবকে ঘিরেই বাজারজাত করি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ কারণে আমরা পর্যাপ্ত ফুল মজুদ করেছি। এখন প্রতি পিস জারবেরা পাইকারি ৭-৮ টাকা দরে, গোলাপ ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সামনে এসব ফুলের তিনগুণ দাম হয়ে যাবে। কারণ এ বছর ভাইরাসের কারণে ফুল নষ্ট হয়েছে। এজন্য চাহিদার তুলনায় ফুলের জোগান কিছুটা কম।’ একই এলাকার ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আসন্ন তিনটি দিবস সামনে রেখে আমাদের প্রস্তুতি বেশ ভালো। গোলাপগুলো ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে। ফুলের পচনরোধে নানা ধরনের ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘আমরা সারা বছর ফুল বিক্রি করি। তবে আমাদের মূল ব্যবসা হয় বেশকিছু উৎসব ঘিরে। এ বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তবে আসন্ন তিন দিবস ঘিরে অন্তত শতকোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।’ কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, যশোরে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয় এবং এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক লোক জড়িত।