
ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে। ব্যবসার প্রসার কিংবা নতুন বিনিয়োগ করা না করা নিয়ে শঙ্কায়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোগের চাহিদা কমেছে। পুরো উৎপাদনব্যবস্থায় শ্লথগতির রেশ। ফলে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে লাভ ও মুনাফার চিত্রও সন্তোষজনক নয়। এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে।
আগের সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে গদিছাড়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। বরং রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতির পথে। অর্থবছরের চার মাসেই রাজস্ব আয়ে টানাটানি চলছে। ঘাটতি ছাড়িয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল এক লাখ ৩২ হাজার ১১২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ এক হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এ সময় আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর—এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে।
চার মাসে ঘাটতি হয় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো। এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এ সময় ভ্যাট বা মূসক আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এ সময়ে এই খাতের লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। আমদানি খাতে ৩৯ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা।
আয়কর খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির পেছনে মূল কারণ এই সময়ে আয়ের সুযোগই তৈরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত থাকায় এই খাতে তার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম আয়কর আদায়ও কমেছে। রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখে ভ্যাট খাত। আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সরবরাহ, জোগানদার পর্যায় পর্যন্ত এই খাতের বিস্তৃতি। এর সর্বশেষ ধাপ ক্রেতা বা ভোক্তা। আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে এই খাত ১১ হাজার কোটি টাকার বড় ধাক্কা খেয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক আদায় করে এনবিআর। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ কমায় আবগারি শুল্কেও পড়েছে এর প্রভাব। শিল্প কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক আদায়ে ঘাটতি দেখা গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানি সহজে বাড়বে না। কিছু ভোগ্য পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায়ও এই খাতে আদায় সাত হাজার কোটি টাকা কমেছে। যদিও এতে দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছে।
জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সবকিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়েছে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলে জানান এনবিআরের শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পটপরিবর্তনের পরও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো নির্বিঘ্নে উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় কেনাকাটায়ও ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও মতের অমিল থাকলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।
বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চাল, আলু, পেঁয়াজ, চিনি, খেজুর, ভোজ্য তেলসহ বেশকিছু পণ্যে শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছে এনবিআর। তবে আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়ার পরও বাজারে সরবরাহ চ্যানেলে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। পণ্যের পরিমাণ কম থাকায় দাম আকাশচুম্বী। বাজারে উধাও হয়ে গেছে বোতলজাত ভোজ্য তেল। অন্য সব পণ্যের ক্ষেত্রে সুবিধা বহাল থাকলেও আমদানির পরিমাণ কম। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় সব পণ্যের দাম ক্রেতাদের সাধ্যের বাইরে। এতে অস্থিরতায় পড়েছে ক্রেতারা।
ডলার সংকটের জেরে এলসি খুলতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী। তবে ভয় ও নানামুখী চাপে প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোজ্য তেল সরবরাহকারী একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপের বিতরণ শাখার প্রধান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এলসি খুলতে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছি না। বরং একাধিকবার এলসি বাতিল করা হয়েছে। যার কারণে বাজারে আমাদের তেল সরবরাহ কমে গেছে।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা ও সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কিছু শিল্প গ্রুপের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা খুবই কঠিন সময় পার করছেন। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে মামলা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এ মুহূর্তে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এখন নতুন ব্যবসা চালু হয়েছে—মামলা বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কারো মতের অমিল হলে মামলা দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তাকে মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন তাদের নামে মামলা বন্ধ করতে হবে।’
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আবদুল মোক্তাদির বলেন, ‘শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা কাম্য নয়। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং ছোট ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতি পার করছেন।’
অর্থনীতিবিদরা মোটা দাগে বড় রাজস্ব ঘাটতির পেছনে চারটি সমস্যা তুলে ধরেছেন। প্রথমত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে মানুষের কেনাকাটা কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীদের সুবিধাবাদী আচরণ। তৃতীয়ত, প্রশাসনকে দাঁড় করাতে অনেক সময় লাগা। চতুর্থত, এনবিআরকে সক্ষমতার চেয়ে বেশি লক্ষ দেওয়া।
জানতে চাইলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় করার খুব একটা সুযোগ ছিল না। যদিও আগস্টের ৫ তারিখে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। তবে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে চলতে পারছে—এমন অবস্থা তৈরি হয়নি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষও কেনাকাটা করতে পারছে না। এখনো আমরা পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারিনি। এটাই প্রধান কারণ। আমাদের রাজস্ব আদায়ের মূল জায়গা পরোক্ষ কর। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকভাবে না চললে এবং মানুষ কেনাকাটা না করলে সেটা আদায় হবে না। আদায় হলেও তা ঠিকমতো জমা পড়ে না।’
জাহিদ হোসেন আরো বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখনো দুর্বল, সবল হওয়ার পথে যায়নি। আগস্ট মাসের মতো জটিল না থাকলেও আগের মতো হয়নি। ব্যবসায়ীরা কর না দেওয়ার প্রবণতার সুযোগ নিচ্ছেন।
প্রশাসনকে দাঁড় করাতে অনেক সময় লেগেছে। পটপরিবর্তনের অনেক লোক গায়েব হয়ে গেছে, অনেকে দায়িত্বেই আসেনি। এনবিআরেও উচ্চ পর্যায়ে এ সমস্যা আছে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের ফলে অর্থনীতিতে একটা চাপ পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এ ছাড়া এনবিআরকে দেওয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও সক্ষমতার চেয়ে বেশি। করজাল সম্প্রসারণ করে এই ঘাটতি পূরণের পরামর্শ দেন তিনি।’
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ জন্য বহুজাতিক সংস্থাটির আরোপিত নানা ধরনের শর্ত মানতে হচ্ছে। রাজস্ব খাতও বাদ যায়নি এই শর্ত থেকে। সে অনুযায়ী, এই খাতে বড় দুটি শর্ত হলো প্রতিবছর জিডিপির দেড় শতাংশ পরিমাণ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে সব ধরনের করছাড় তুলে দিতে হবে।