
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে মামলাটি অবৈধ ছিল।
হাইকোর্টের রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দুই দশক ধরে চালানো প্রপাগান্ডার অবসান হলো।
এদিকে বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়ায় বগুড়ায় আনন্দ মিছিল করেছে জেলা বিএনপি।
দুই দশক আগে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ ঘোষণা করে গতকাল রবিবার তা বাতিল করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ বিচারিক আদালত যাদের সাজা দিয়েছিলেন, তাদের সবাই খালাস পেয়েছেন। তবে খালাসের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিত বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
বিচারিক রায়ের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও দণ্ডিত কয়েকজনের আপিল শুনানির পর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এই রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, আইনের ভিত্তিতে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়নি। ফলে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ। তাই বিচারিক আদালতের ডেথ রেফারেন্স নাকচ এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করা হলো।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও ২৫ জন শ্রুত সাক্ষীর জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত এই রায় দিয়েছেন। এই ২৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দির একটি আরেকটিকে সমর্থন করেনি। কোনো চাক্ষুস সাক্ষী ছিল না। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো প্রমাণযোগ্য বা আইনগত মূল্য নেই। কারণ জীবদ্দশায় তিনি তাঁর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে গেছেন।
এই স্বীকারোক্তি জোর করে নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে। তা ছাড়া মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিটি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা যথাযথ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়নি।’
তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন : কায়সার কামাল
বিচারিক আদালতের রায়ের আগে থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এই মামলায় পলাতক দেখানো হয়। ফলে হাইকোর্টে তার পক্ষে আপিল করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
হাইকোর্টের এই রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া দেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন। প্রমাণ হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশে তাকে এই মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল। সেই মামলা আইনগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘গত দুই দশক এই মামলা দেশের রাজনীতিতে প্রভাব রেখেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রপাগান্ডার শিকার হয়েছেন তারেক রহমান। আমরা ও দেশবাসী মনে করে, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন।’
রায়ের পর লুত্ফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলার ডেথ রেফারেন্স খারিজ ও বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে দণ্ডিতদের আপিল মঞ্জুর এবং বিচারিক আদালতের রায় বাতিল প্রশ্নে রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়েছে। রায়ে সব আসামি খালাস পেয়েছেন।’
এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জোনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মনে করি আপিল করা উচিত। রায় দেখে সিদ্ধান্ত নেব।’
মামলার বৃত্তান্ত
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের দাবি, এই হামলা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়। ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরো ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে। দুই মামলায় মোট ৫২ আসামির বিচার শুরু হলেও অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মোট ৪৯ আসামির বিচার করেন বিচারিক আদালত।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই মামলার রায় হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে।
এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব প্রয়াত হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের পর ওই বছরের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় এসে পৌঁছে। দণ্ডিতরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল-জেল আপিল করেন।
ফের শুনানি
ডেথ রেফারেন্স-আপিলের পেপারবুক প্রস্তুত হলে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর শুরু হয় শুনানি। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর বিচার বিভাগেও পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের পর আপিল বিভাগের আরো পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১, ১২ ও ১৫ আগস্ট এখতিয়ার পরিবর্তন করে হাইকোর্টের ৫৪টি হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন করেন। বেঞ্চ পুনর্গঠনের পর মামলাটি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে আসে। গত ৩১ অক্টোবর এই বেঞ্চে নতুন করে শুনানি শুরু হয়। গত ২৮ নভেম্বর চূড়ান্ত শুনানির পর মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রেখেছিলেন। সে ধারাবাহিকতায় মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়ে গতকাল রায় দিলেন উচ্চ আদালত।
আদালত আমাদের ন্যায়বিচার দিয়েছেন : বাবরের স্ত্রী
এ মামলায় বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। পরে খালাস চেয়ে তিনি আপিল করেছিলেন। বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অবশেষে ন্যায়বিচার পেয়েছি। এ কারণে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি শুকরিয়া জানাই, আলহামদুলিল্লাহ।’
বগুড়ায় বিএনপির আনন্দ মিছিল
বগুড়া প্রতিনিধি জানায়, বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়াই গতকাল বগুড়ায় তাত্ক্ষণিক আনন্দ মিছিল করেছে জেলা বিএনপি। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় নবাববাড়ির দলীয় কার্যালয় থেকে বগুড়া জেলা বিএনপির উদ্যোগে আনন্দ মিছিল সাতমাথা হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। আনন্দ মিছিল শেষে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী আজগর তালুকদার হেনা প্রমুখ।