
আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার থেকে পদোন্নতি ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে অন্তত চার হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। সরকার গঠিত পর্যালোচনা (রিভিউ) কমিটি প্রাথমিক যাচাই করার পর তা দুই হাজারে নেমে এসেছে। আবেদনগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক তালিকা তৈরি করা হচ্ছে, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। বঞ্চনার কারণ, প্রতিকার ও সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জমা দিতে চায় রিভিউ কমিটি।
প্রতিবেদনে রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
রিভিউ কমিটির আহ্বায়ক সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিটির কাছে অনেক আবেদন এসেছিল। প্রাথমিক যাচাইয়ে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা দুই হাজারের কাছাকাছি।
কেউ কেউ একাধিক আবেদন করেছেন। অনেকে গত সরকারের আমলে সচিব হয়েছেন, তিনি সিনিয়র সচিব হতে আবেদন করেছেন। আবার আগের সরকারের সময় ভালো (গুরুত্বপূর্ণ) পদে ছিলেন, তাঁরাও আবেদন করেছেন। আমরা এজাতীয় আবেদন আমলে নেব না। এসব কারণে আবেদন কমে গেছে।’
তাহলে কাদের আবেদনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সচিব বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে যাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল, যাঁরা দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে গেছেন, বছরের পর বছর ‘গুরুত্ব্বহীন’ পদে ফেলে রাখা হয়েছিল, ছোট অপরাধে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদেরই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে কমিটি। এ ছাড়া আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শেষে ওয়েবসাইটে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
জানা গেছে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু ‘রাজনৈতিক’ তকমা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনে হাজারো কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে ‘গুরুত্ব্বহীন’ পদে।
মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য অনেক কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে ফেলে রাখা হয়েছিল মাসের পর মাস। কাউকে কাউকে দেওয়া হয়েছিল বাধ্যতামূলক অবসরও। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসে। প্রশাসনে আসে আমূল পরিবর্তন। শেখ হাসিনার সময় চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করে অবসরে থাকা বঞ্চিত যোগ্য কর্মকর্তাদের প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসনে কর্মরত প্রায় ৫০০ কর্মকর্তাকেও দেওয়া হয় পদোন্নতি। এরপর অতীতে যাঁরা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এবং বছরের পর বছর ধরে ওএসডি ছিলেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণের দাবি ওঠে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সরকারি চাকরিতে বঞ্চিতদের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে প্রধান করে গঠন করা এই কমিটির সদস্য আছেন মন্ত্রিপরিষদ, অর্থ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ের চার প্রতিনিধি। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এবং এই সময়ের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনাপূর্বক যথাবিহিত সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। এর পরই মূলত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদন জমা পড়তে শুরু করে। এরপর দুই দফা বাড়িয়ে গত ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বঞ্চিতদের আবেদন নেওয়ার সময়মীমা বেঁধে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা ও পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরে যাওয়া প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে আবেদন জমা দেন মন্ত্রণালয়ে। আবেদনগুলো প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ। এরই মধ্যে কমিটি ১৫-১৬টি বৈঠক করেছে। তারা নির্ধারিত ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে চায়। বঞ্চিতদের আবেদনগুলো কমিটি পর্যালোচনা করছে। প্রতিটি আবেদনে যে দাবি করা হয়েছে, তার পক্ষে তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কেন পদোন্নতিবঞ্চিত হলেন, তার কারণও খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) নম্বর, পদোন্নতিযোগ্য নম্বর তাঁর ছিল কি না, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয়, শৃঙ্খলা, আত্মসাৎ, তছরুপ, কিংবা দুর্নীতির মামলা ছিল কি না, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) যে ব্যাচে তিনি চাকরিতে যোগদান করেছেন, সেই ব্যাচে কম্বাইন্ড ও নিজ ক্যাডারে তাঁর অবস্থান কত ছিল—সব কিছুই চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে কমিটি।
এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর কমিটি গঠন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান নিজ দপ্তরে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রশাসনে বঞ্চিত হয়েছেন এমন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনে বঞ্চিতদের আড়াই হাজার আবেদন জমা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে কমিটি এই তালিকা জমা দেবে। সবার আগে আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয় বিবেচনা করা হবে। যাঁরা এখনো কর্মক্ষম কিন্তু চাকরি চলে গেছে, তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে।’