
ডাইনি দেখতে কেমন হয়? বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরের চোখেও ভেসে উঠবে এমন একটি নারী রূপ, যে লম্বা আলখাল্লায় নিজেকে জাগিয়ে রাখে। আর তার বাহন হলো একটি ঝাড়ু। কেমন জীর্ণ, ভাঙা সেই ঝাড়ুর লম্বা ডাঁটির ওপর বসে সে ভেসে বেড়াতে পারে। পাশাপাশি তার একটি হ্যাটও রয়েছে। সেই ডাইনির আবার নাক লম্বা। সে দেখতে লম্বা আর নোংরা। গবেষকরা বলছেন, আমেরিকান পপ-সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পেছনে এই ডাইনি সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। উইককানের পুরোহিত এবং সাংবাদিক মার্গট অ্যাডলার তার একটি বইয়ে লিখেছেন, ‘ডাইনি নিছক একটি শব্দ নয় বরং একটি ভাবনার পদ্ধতি। হাজার হাজার বছর ধরে গ্রিক পুরাণ এবং বাইবেল থেকে শুরু করে আধুনিক দুনিয়ায়ও ডাইনি নামক চরিত্র রয়ে গেছে। পৌরাণিক, লোককাহিনি এবং চলচ্চিত্রের অনেক জাদুকরি ঘটনায় অপরিহার্য এই ডাইনি।
আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেরা খলনায়কদের তালিকায় চার নম্বরে রয়েছে ‘দ্য উইজার্ড অব ওজ’র সেই ডাইনি। ১৯৩৯ সালে ওই সিনেমায় প্রকাশিত ডাইনির রূপই এখনো দর্শকদের ভয়ে বা হাসিতে কেঁপে উঠতে সহায়তা করে। তবে এর ভয়ংকর দিকের নাম ‘উইচ হান্ট’। ফেব্রুয়ারি ১৬৯২ থেকে মে ১৬৯৩ সালের মধ্যে মাত্র ১৬ মাসে ২০০ ‘ডাইনিকে’ দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যাদের বেশিরভাগ ছিল নারী। যাদের জাদুবিদ্যা অনুশীলনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এই ২০০ জনের মধ্যে ৩০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যাদের ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ব্রিজেট এম. মার্শাল লোয়েল উইচ হান্ট নিয়ে লিখেছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য বিরক্তিকর দরিদ্র এবং ভিন্ন বর্ণের নারীকে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করা সহজ ছিল। ইউরোপ ১৫ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত উইচ হান্টিংয়ের উন্মাদনার কাল পার করেছে। শয়তানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র এবং অভিশাপের মতো ধর্মদ্রোহী কাজ করার অভিযোগে আনুমানিক এক লাখ লোকের বিচার করা হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং ইউরোপের প্রারম্ভিক আধুনিক লোকেরা জাদুবিদ্যা এবং অতিপ্রাকৃততায় বিশ্বাস করত। তারা চাপের সময়ে, প্রতিকূল ঘটনার জন্য কথিত ডাইনিদের দোষ দিত। ব্যর্থতা, ফসল নষ্ট, অসুস্থ গবাদিপশু এই ধরনের দুর্ভাগ্য ডাইনির ক্ষতিকারক জাদু দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে করত। যে কারণে উইচ হান্টিং এবং জাদুবিদ্যাকে অভিযুক্ত করা শুরু হয় ১৫ শতকের গোড়ার দিকে, যা ৩০০ বছর ধরে অব্যাহত ছিল। ১৪০০ থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত মূল ভূখন্ড ইউরোপ এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ নিরীহ মানুষকে ডাইনি ঘোষণা করে তাদের বিচার করা হয়। তাদের কাউকে কাউকে পুড়িয়ে বা ফাঁসির মাধ্যমে হত্যা করা হয়।প্রথম ঘটনা
ইংল্যান্ডের ম্যাসাচুসেটসের অন্যান্য শহরের মতো সালেমেও বিশুদ্ধ ধর্ম পালনকারীরা বসবাস করত। এ এলাকার আদিবাসী বাসিন্দাদের সঙ্গে তারা থাকত। সেখানে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস করা হয়েছিল। এ ছাড়া যুদ্ধের ফলে এখনকার কানাডা এবং নিউইয়র্ক থেকেও বাস্তুচ্যুত হওয়া শরণার্থীরা সেখানে ছিল। এসব নতুন বাসিন্দার সঙ্গে সালেমে আগে থেকে বসবাসকারী গ্রামবাসী এবং তাদের ধর্মীয় ও সরকারি নেতাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অন্যান্য অনেক দ্বন্দ্বের একটি ছিল গির্জার নেতাকে নিয়ে। কারণ শহরে স্থায়ী মন্ত্রী রাখতে সমস্যা দেখা দেয়। একজন মন্ত্রীকে ধরে রাখার জন্য একাধিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, এ দায়িত্বে গ্রামের গির্জার নেতা স্যামুয়েল প্যারিসকে নিয়োগ করা হয়। প্যারিসের তার কঠোর ও গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি এবং বেতন নিয়ে ঝগড়া করে শুরু থেকেই বিতর্কে জড়ান। ১৬৯২ সালের জানুয়ারিতে প্যারিসের নয় বছর বয়সী কন্যা এলিজাবেথ এবং ১১ বছর বয়সী ভাইঝি অ্যাবিগেল উইলিয়ামস ভবিষ্যৎ বলার একটি খেলা খেলতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। বিশুদ্ধ ধর্ম পালনকারীদের কাছে এ ধরনের আমোদ-প্রমোদকে দুষ্ট বলে মনে করা হতো। এ খেলায়মেয়েরা এক গ্লাস পানিতে ডিমের সাদা অংশ ফেলে দেয়। পানিতে পড়ার পর ডিমের ওই সাদা অংশ যে আকার পায় তা দেখে তারা তাদের ভবিষ্যৎ স্বামীর পেশা কী হতে পারে সেটা অনুমান করে। খেলতে গিয়ে ওই দুই বালিকা কফিনের মতো আকৃতি দেখতে পেয়ে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। তারা উচ্চৈঃস্বরে অসংলগ্ন শব্দ করতে থাকে। হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে এবং মেঝেতে পড়ে যায়। তাদের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে যায়। শহরের চিকিৎসক বলেন, ডাইনির মন্ত্র বা অভিশাপের অধীনে শয়তানকে তাদের দখলে নিয়েছিল।ম্যাসাচুসেটস আইনে জাদুবিদ্যা এবং শয়তানের সঙ্গে সখ্য অপরাধ ছিল। যার কারণে ওই দুই মেয়ের এমন আচরণ দ্রুত একটি আইনি বিষয়ে পরিণত হয়। তদন্তে চলে আসে প্যারিসের মালিকানাধীন এক ক্রীতদাস নারীর নাম। যিনি জাদুবিদ্যা দিয়ে ওই দুই মেয়েকে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। ওই দুই মেয়ে জানায়, তারা অজ্ঞান হয়ে গেলে তিতুবা এক ধরনের কেক খেতে দেন তাদের। যদিও তিনি ভাগ্য বলার খেলায় জড়িত ছিলেন না। কিন্তু ‘তিতুবার ওই কেক খাওয়ানো ছিল জাদুবিদ্যার অংশ। প্যারিস যখন জানতে পারলেন, তিতুবা তাদের খাবার তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন, তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারধর করেন। চাপের মুখে, তিতুবা জাদুবিদ্যার কথা স্বীকার করে, স্বীকার করে যে সে ‘শয়তানের দাস’। গবেষকরা বলেন, তিতুবা সহজ লক্ষ্য ছিল, কারণ সমাজে সে নিম্ন শ্রেণির বলে বিবেচিত ছিল। সামাজিক চাপের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যায় দায়ী করার জন্য বলির পাঁঠা খোঁজা হয়। তিতুবা ছিল সেইবলির পাঁঠা। ওই দুই মেয়ের অসুস্থতার জন্য আরও দুই নারীকে দোষী করা হয়। একজন সারাহ ওসবোর্ন এবং অপরজন সারাহ গুড। তারা দুজনই ছিলেন দরিদ্র। এ তিনজনকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুবিদ্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, জেলে পাঠানো হয় এবং বিচার করা হয়।
চিহ্ন
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ইতালীয় গবেষণার অধ্যাপক ওয়াল্টার স্টিফেনস বলেছেন, ডাইনিরা কালো রঙের পোশাক পরে কারণ এটি রাতের এবং ভয়ের রঙ। কার্যত কালোও একটি সাধারণ এবং বাজেটবান্ধব পোশাকের রঙ ছিল। আর ডাইনিদের হ্যাট বিষয়ে স্টিফেনস বলেন, এগুলো ডান্স ক্যাপ থেকে উদ্ভূত হতে পারে, যা ধর্মবাদীদের পরতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৬০০-এর দশকে একটি নতুন ধর্মের সদস্যদের কাঁটাওয়ালা কালো শঙ্কুযুক্ত টুপি প্রতিদিন পরতে হতো। এমন আকৃতির টুপি আবার সাধারণত মধ্যযুগীয় অভিজাত নারীরা। এই প্রবণতা গ্রামাঞ্চলেও প্রবেশ করে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে তীক্ষè কালো টুপি মধ্যযুগীয় অনুরূপ হেডওয়্যার থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে মদ্যপানব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করা একটি গোষ্ঠী এ ধরনের টুপি পরত। তারা সমাজের প্রান্তে একটি অবস্থান দখল করে। এসব টুপি তারা পরত যেন বাজারে গেলে তাদের দেখা যায়। কেউ কেউ দাবি করেন, তীক্ষèাগ্র টুপি জুডেনহুট নামক একটি শঙ্কুযুক্ত টুপি থেকে উদ্ভূত হতে পারে। যেটি মধ্যযুগীয় ইউরোপে ১৩ শতকে ইহুদিরা নিজেদের শনাক্ত করার জন্য পরতে বাধ্য হয়েছিল।
১৪৩১ সালে হাঙ্গেরিয়ান আইনে প্রথমবারের মতো জাদুবিদ্যার অপরাধীদের জনসমক্ষে এমন ‘ইহুদিদের টুপি’ পরতে বাধ্য করা হয়েছিল। আবার সেই আঁকাবাঁকা নাকও ইহুদি আদলের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। কিছু প-িত মনে করেন, ডাইনিদের নাক ইহুদিদের চিত্রিত করতে ব্যবহৃত ব্যঙ্গাত্মক নাক। এ ছাড়া ধারণা করা হতো হেকেট জাদুবিদ্যার দেবী। তার একটি পোষা বিড়াল আছে। যে কারণে কালো বিড়ালকে আনুষ্ঠানিকভাবে শয়তানের অবতার হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৩ শতকের গির্জায়। এ ছাড়া বলা হতো, বিড়াল শাস্ত্রে বিশ্বাসঘাতকদের একটি উপযুক্ত প্রতীক। কারণ বিড়ালরা সবসময় একে অপরের জন্য ফাঁদপেতে থাকে। যদিও বাস্তবে ডাইনিরা কখনও ঝাড়ুতে চড়ে ওড়েনি। তবে এটা সত্য, ঝাড়ু একচেটিয়াভাবে নারীর প্রতীক হয়ে আছে সমাজে। যা তারা ঘর পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করে। যা ধীরে ধীরে ডাইনিদের বাহনে পরিণত হয়। সম্ভবত সিনেমার মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয়, যা ক্রমে ডাইনিদের প্রতীকে পরিণত হয়।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ‘সাগর ডাইনি’ বলে একটি ধারণা ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে চালু আছে। তাদের লোককাহিনিতে শতকের পর শতক ধরে নানা গল্প তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সাগর ডাইনিদের উদয় হয় নাবিকদের সামনে। মাঝে মাঝে সাগর ডাইনিদের আবার ডাকিনীবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় যারা চাঁদ, জোয়ার ও আবহাওয়ার সঙ্গে জড়িত বলে ভাবা হয়। কিছু লোককাহিনিতে সাগর ডাইনিদের অশরীরী বা প্রেত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা জাহাজ ও নাবিকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। তারা প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, সাগর বা মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে নাবিকরা বিশ্বাস করত। পানি আছে এমন যেকোনো কিছু, যেমন পুকুর, নদী, পানির চৌবাচ্চা, লবণ গোলানো পানির পাত্র বা বাতাসও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ভারতীয় এবং বাংলা সাহিত্যেও অনেক সাগর ডাইনির উদাহরণ আছে যেমন মঙ্গল কাব্যের কমলে কামিনী, রামায়ণের রাক্ষসীসুরসা যে হনুমানকে গিলতে চেষ্টা করেছিল ইত্যাদি।