
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে সংস্কারে নেমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করছাড়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছে; যাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিতে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা কর অব্যাহতির তথ্য উঠে এসেছে।
এরমধ্যে বিদ্যুৎ, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন খাতের নির্দিষ্ট পণ্য আমদানিতেই অর্ধেকের বেশি শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির জন্য সম্প্রতি তৈরি করা এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিতে করছাড় দেওয়া হয়েছে ৩৩ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১৯ শতাংশ বেশি।
এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এ খাতে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অব্যাহতি কত ছিল তা এখনও বিশ্লেষণ করা হয়নি।
মূলত পণ্য আমদানির পর্যায়ে নির্ধারিত হারে আরোপ করা শুল্ক ও করে সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত মেনে দেওয়া অব্যাহতি বা রেয়াতই করছাড়।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার সমঝোতা চুক্তিতে অন্যান্য শর্তের সঙ্গে করছাড় তুলে দেওয়ার বিষয়েও সম্মতি দেয় বাংলাদেশ। তাদের পরামর্শেই ২০২১-২২ অর্থবছরকে মূলভিত্তি ধরে এ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
তবে করছাড় তুলে দেওয়ার বিষয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ বড় আকারে অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে এক্ষেত্রে ধীরে হাঁটছে এনবিআর।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, এ সংস্কৃতি থেকে আরও আগেই বেরিয়ে আসা দরকার ছিল। এখন হুট করে সব তুলে দেওয়া যাবে না। সঠিক পর্যালোচনা করে যৌক্তিক কাঠামোতে কর ছাড় তুলতে হবে।
এতদিন পরে হঠাৎ এমন তথ্য বিশ্লেষণের বিষয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, সামনের দিনে রাজস্ব খাতে সংস্কারে সহায়তার অংশ হিসেবে বিশ্লেষণের এ কাজ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনটি আইএমএফের জন্য প্রস্তুত করা হলেও নিয়মিত বিশ্লেষণ থেকে এসব তথ্য নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রাখবে। এটি অনুমোদনের পর তা এনবিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনটির মুখ্য প্রদায়ক (প্রিন্সিপাল কন্ট্রিবিউটর) মুকিতুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ’’আমরা এমন একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছি। এর মাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী কাজ শুরু করলাম। সামনের দিনে আমাদের নীতি গ্রহণে আরও বেশি যৌক্তিক হওয়ার সুযোগ থাকবে।
“সেই নীতির প্রভাব আসলে কী হচ্ছে, আদৌও যেজন্য নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে কি না সেটিও সামনের দিনে বিশ্লেষণ করা হবে।”
চলতি অর্থবছরের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী করছাড় তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর ছাড় দাঁড়াবে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কর ভর্তুকির হিসাব যোগ করলে তা বাজেট ঘাটতির চেয়েও বেশি হবে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এ করছাড়ের এ হিসাব মূলত আয়করের ছাড়। এর বাইরে আমদানি ও ভ্যাটেও ছাড় দেওয়া হয়।
প্রকৃত অব্যাহতি কত?
আইএমএফ কর অব্যাহতি বা করছাড়কে কর ব্যয় হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। অপরদিকে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে এ ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ও বাণিজ্যে সহায়তা করা হয় বলে সরকারের বিবেচনায় এটি ব্যয় বা এক ধরনের বিনিয়োগ।
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে এক সেমিনারে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম আমদানিতে ৬৪ হাজার কোটি টাকা কর অব্যাহতির তথ্য তুলে ধরেছিলেন। তখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ওই ছাড় দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি।
এনবিআরের বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে করছাড়ের যে তথ্য উঠে এসেছে তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
একই তথ্য এত ভিন্ন কেন, এমন প্রশ্নে মুকিতুল হাসান বলেন, “আমদানির সময় আমরা যেসকল কর নিয়ে থাকি তার সবই শুল্কের না, যেমন অগ্রিম আয়কর। এটি আয়কর অনুবিভাগের বিষয়, কিন্তু আমদানিতে এটি পরিশোধিত হয়। আমরা এটি বাদ দিয়েছি।”
এছাড়া আবগারি (এক্সাইজ) শুল্ক ও অগ্রিম কর বাদ দেওয়া হয়েছে। আবগারি শুল্ক মূসকের অংশ এবং অগ্রিম কর পরে সমন্বয়যোগ্য।
আয়কর ও মূসকে করছাড়ের ক্ষেত্রে এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়করে কর ব্যয় বা রাজস্ব ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে এটি ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয় কোম্পানিগুলোকে এবং ৪৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ছাড় পায় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা।
ভ্যাটের মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেওয়া অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
এ দুই অনুবিভাগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের কর ছাড়ের বিশ্লেষণ এখনও হয়নি।
বেশি অব্যাহতিতে ক্ষতি কী?
যেসব দেশে এখনও কর ও জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ এখনও মাত্র ৭ দশমিক ৬ শতাংশের মত।
এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরামর্শ দীর্ঘদিনের। কর আদায় কম হওয়ায় বাংলাদেশ উচ্চ হারে শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়। এটি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে বলে মত দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা।
এছাড়া কর অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করে বলে অভিযোগ অর্থনীতিবিদদের। বছরের পর বছর অব্যাহতি দিলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো যায়নি। কর ছাড়ের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি থাকলেও সেভাবে পরে আর রাজস্ব বাড়েনি। বরং এতে সরকারের ঘাটতি বাজেট বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেই ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে। সেই ঋণ পরিশোধের চাপও বেড়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো কর ছাড়ের সুবিধা নিলেও সেভাবে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাড়াতে পারেনি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় যেমন বাড়েনি, তেমনি পরে রাজস্ব আহরণও বাড়েনি।
এছাড়া ঘাটতি মেটাতে সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানোর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়। এ অর্থ মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়।
তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিশ্লেষণের দাবি
অর্থনীতির বিশ্লেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর হঠাৎ করে কর অব্যাহতি কমার তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”অগ্রিম আয়কর কীভাবে কাস্টমসের বিষয় হল বুঝলাম না।”
তার ভাষ্য, “৩০ হাজার কোটি টাকার হিসাব উধাও হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। রাষ্ট্রের একই প্রতিষ্ঠান একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে। এ ধরনের ভুল আরও চলতে থাকলে সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলবে। রাষ্ট্রীয় তথ্য এভাবে হতে পারে না।“
আইএমএফের এর সাবেক এই কর্মকর্তা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কর ব্যয় বিশ্লেষণের পরামর্শ দেন।
এনবিআরের ভাবনা কী?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির এক আলোচনা সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিমের দেওয়া বক্তব্যে করছাড় বিষয়ে সরকার ও এনবিআরের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়।
ওই সভায় তিনি বলেছিলেন, “উৎপাদন ও শিল্পে নজর দিতে গিয়ে কর ব্যয় বেড়েছে। আমরা নজর দিয়েছি ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি বাড়বে সেসব খাতে।
“ফলে আমাদের বরোয়িং মার্জিন অনেক বেশি। মোর বরোয়িং ইজ গুড ফর ইকোনমি। আমাদের ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি বেড়েছে। ফলে দেশের রাজস্ব কম বলে আমি দুশ্চিন্তা করি না।“
সেসময় কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “আমরা বলি সবাই ট্যাক্স দিতে চাই, ভ্যাট দিতে চাই। কিন্তু দেখা যায় আসলে ব্যক্তি পর্যায়ে দিতে চায় না।
“শুধু তাইই নয়, করপোরেটগুলো বিভিন্নভাবে তদবির করে অব্যাহতির জন্য। আমরা যদি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চাই, তাহলে এই মানসিকতা বাদ দিতে হবে।“