
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি
অধ্যাপকদের অপরাধ আড়াল করেছে কি শ্বেতপত্র কমিটি!
👇
গত দেড় দশকে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, পুঁজিবাজারসহ আর্থিক খাতে নজিরবিহীন যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহযোগীর ভূমিকা রেখেছেন। আবার কেউ পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালক হিসেবে বাজার কারসাজিতে সহায়তা করেছেন। সরকারি-বেসরকারি যেসব ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সেগুলোরও নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় ছিলেন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহযোগিতার দায়ে অভিযুক্ত এসব অধ্যাপকের সিংহভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহযোগী কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখা এ অধ্যাপকদের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও ড. এম খায়রুল হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. খন্দকার বজলুল হক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিব উদ্দিন আহমেদ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. মো. কামাল উদ্দিন এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সাবেক পরিচালক ড. সেলিম মাহমুদ প্রমুখের। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এসব অধ্যাপকদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন কিংবা আছেন।
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেশ কয়েকজন অধ্যাপক আর্থিক খাতে অনিয়মে সহযোগী ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ছিলেন। আর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মো. সেলিম উদ্দিন ও ড. মোহাম্মদ সালেহ জহুর ইসলামী ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালক ছিলেন। এর মধ্যে সেলিম উদ্দিন প্রায় সাত বছর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক থাকার পর ২০২৩ সালের জুনে ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ পেয়েছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক মো. হেলাল উদ্দীন নিজামী ছিলেন বিএসইসির আলোচিত কমিশনার। তার বিতর্কিত ভূমিকা দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার ইসলামী ব্যাংকে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির সময়ে ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ্ বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু গত দেড় দশকে অধ্যাপকরা যেভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী হয়েছেন, তাতে সে সম্মানও ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত আওয়ামীপন্থী অধ্যাপকরা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেননি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাও দুর্নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠিত সম্পদের অংশীদার হয়েছেন।
গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এরই মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে দেশের আর্থিক খাতের অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হলেও এর পেছনে থাকা কুশীলবদের বিষয়টি উঠে আসেনি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্নও উঠেছে।