বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থনীতিতে প্রধান তিন চ্যালেঞ্জ- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বহিস্থ খাতের চাপকে সামনে রেখে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেটি কমে ৪ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
যদিও শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে আলোচিত অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাটি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় সেই পূর্বাভাস এখন কমানো হলো। তবে একবছর পরেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে নতুন পূর্বাভাস জানানো হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে ওয়াশিংটন থেকে বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ধ্রুব শর্মা, অর্থনীতিবিদ নাজমুস খান এবং জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা ও বহিস্থ খাতের চাপ। এ ছাড়া বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এসব কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি খুব বেশি বাড়বে না। এটি শ্লথ হয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। মধ্যবর্তী পয়েন্ট হবে ৪ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে বেড়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে আবার ৯ শতাংশ নেমে আসতে পারে। তবে সরবরাহ-দিকের সমস্যাগুলো স্থিতিশীল না হলে এবং বিচক্ষণ আর্থিক ও রাজস্ব নীতি বজায় রাখা না গেলে এটি কমার সম্ভবনা কম।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। নানা উদ্যোগ নিয়েও এটি কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। যা সাধারণ মানুষের জীবনমানকে নিচে নামাচ্ছে। পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে বাংলাদেশে।’
খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানান বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ধ্রুব শর্মা। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সূচকের ৪৫ শতাংশই হিসাব করা হয় খাদ্যপণ্যের দাম দিয়ে। ফলে খাদ্যের দাম বাড়ায় তা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।’
আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে নানা ধরনের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। সরকারের অনেক প্রচেষ্টার পরও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ কমেছে।
আর বহিস্থ খাতের চাপের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই চাপের ফলে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শ্লথ হয়ে পড়েছে। ২০২৪ অর্থবছরে এটি ৮০ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০২৩ অর্থবছরে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। তবে ২০২৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে চলমান বিনিময় হার ব্যবস্থার দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে ক্রলিং পেগ বিনিময় হার সিস্টেম বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান কমে যায়।
ব্যাংকিং খাতে যখন তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এ খাতে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ বিষয়ে ধ্রুব শর্মা বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং বিনিময় হারের নমনীয়তা বাড়লে ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও বিদেশি খাতের ওপর চাপ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কর্মসংস্থানে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিবছর উৎপাদন খাতে গড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিপরীতে এ খাতে প্রতিবছর কর্মসংস্থান ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে কমেছে। বেশির ভাগ, প্রায় সাড়ে ৪৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে কৃষি খাতে। এ খাতে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থানই হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক ও নিম্ন মজুরির।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহ—উভয় দিক দিয়েই চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানায় বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই এসএমই খাতের। ফলে তারা অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় কম। অন্যদিকে খাতভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদেরও অভাব রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের জন্য ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এ বিষয়ে আবদৌলায়ে সেক বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির তথ্য এলেও তা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক ও নারীদের অনেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরি খুঁজে পান না। আর সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের শিল্প ও সেবা খাতের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালোর দিকে।’
তবে বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভালো ইতিহাস রয়েছে বলে জানান আবদৌলায়ে সেক। তিনি বলেন, ‘আশা করছি, সরকার দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নত করতে জরুরি ও সাহসী সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এর মাধ্যমে দেশ লাখ লাখ যুবকের কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে পারবে।’
।। প্রকাশক ও সম্পাদক : মো: শিহাব উদ্দিন ।। নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস. জয় ।।
দৈনিক জন জাগরণ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@২০২৫You cannot copy content of this page