জন গাগরণ ডেস্ক :
মানবসভ্যতার ইতিহাসে একবারই এসেছেন যিনি ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও নৈতিকতার প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদর্শ স্থাপন করেছেন। তিনি হলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরবের মর্যাদাশালী কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। জন্মের পূর্বেই তিনি পিতৃহারা হন। আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শই হলো মুসলমানদের জন্য শ্রেষ্ঠ অনুসরণযোগ্য পথ।
অতি অল্প বয়সেই নবীজি মাতৃহারা হয়ে পড়েন। ফলে প্রথমে দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব তাঁকে লালনপালন করেন। শৈশবে তিনি রাখালের কাজ করেছেন এবং পরে ব্যবসায় জড়িত হন। তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও চরিত্রের কারণে তিনি “আল-আমিন” নামে খ্যাত হন। যৌবনে তিনি ব্যবসার কাজে অংশগ্রহণ করেন এবং সততার জন্য সবার আস্থা অর্জন করেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজা (রা.) তাঁর সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদারিত্ব করেন। পরে খাদিজা (রা.) তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে বিবাহ প্রস্তাব দেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সুখের ও শান্তিময়।
চল্লিশ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহি লাভ করেন। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাঁকে আদেশ করেন- “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” এভাবেই নবুওয়াত প্রাপ্তির সূচনা হয়। প্রথমে তিনি গোপনে দাওয়াত দিতে শুরু করেন এবং পরবর্তীতে প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করেন।
নবীজি (সা.) মানুষকে এক আল্লাহর উপাসনায় আহ্বান জানান। তিনি মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিন্তু মক্কার কাফেররা তাঁর দাওয়াতের বিরোধিতা করে এবং নানা নির্যাতন চালায়। মুসলমানরা চরম কষ্টের সম্মুখীন হন। কেউ কেউ শহীদ হন, কেউ কেউ বিদেশে হিজরত করতে বাধ্য হন। তবে নবীজি (সা.) ধৈর্য হারা হননি। তিনি সাহাবীদের ধৈর্য ধারণ করতে বলেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে শিক্ষা দেন।
মক্কায় নির্যাতন বেড়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি মুসলমানদের জন্য এক শক্তিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি মুসলিম ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা ছিল বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান। তিনি মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ করেন এবং একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। মদিনা থেকেই ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে।
মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও মক্কার কাফেররা শান্তিতে থাকতে দেয়নি মহানবীকে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়- বদর যুদ্ধ, উহুদ যুদ্ধ,খন্দক বা আহযাব যুদ্ধ, খাইবার যুদ্ধ, মক্কা বিজয়
হুনাইন যুদ্ধ, তাবুক যুদ্ধ সহ মতান্তরে মোট ২৭ টি যুদ্ধ মহানবী (স.) সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
নবীজি (সা.) যুদ্ধে কখনো নারী, শিশু ও নিরীহ মানুষকে আঘাত করতে দেননি। তিনি যুদ্ধেও মানবতা রক্ষা করতেন।
হিজরতের অষ্টম বছরে মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করেন। সে সময় নবীজি (সা.) ক্ষমার মহত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা করেন- “আজ তোমাদের জন্য কোনো ভর্ৎসনা নেই। তোমরা মুক্ত।” এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। হিজরতের দশম বছরে নবীজি (সা.) বিদায় হজ্ব পালন করেন। সেখানে তিনি ঐতিহাসিক বিদায় খুতবা প্রদান করেন। এতে তিনি ঘোষণা করেন- তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত একে অপরের জন্য হারাম। নারী-পুরুষের অধিকার রক্ষা করো। ধনী-গরিব, কালো-সাদা, আরব-অনারবের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। কুরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরলেই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে মহানবী সম্পর্কে বলেন “তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা কলম, আয়াত ৪)। তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতা, দয়া ও করুণা, সহনশীলতা ও ধৈর্য, ন্যায়বিচার, নম্রতা ও বিনয়, এতিম, দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি মমত্ববোধ।
আজকের বিশ্বে যখন অশান্তি, অন্যায়, দুর্নীতি, যুদ্ধ ও বৈষম্য বাড়ছে, তখন নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সামাজিক ন্যায়বিচারে তিনি সকল মানুষের অধিকার রক্ষার শিক্ষা দিয়েছেন। শান্তি ও ভ্রাতৃত্বে তিনি যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে শান্তি ও ক্ষমার পথ দেখিয়েছেন। শিক্ষার গুরুত্ব তিনি বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। নারীর অধিকারে তিনি নারীর মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সুদ, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে (হিজরতের ১১তম বছর) মহানবী (সা.) ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে গোটা উম্মাহ শোকাহত হয়। তবে তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষা আজও মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) কেবল মুসলমানদের নবী নন, তিনি সমগ্র মানবতার জন্য রহমত। তাঁর জীবন হলো শান্তি, ন্যায় ও মানবতার আলোকবর্তিকা। আজ যদি পৃথিবী সত্যিই শান্তি চায়, তবে নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন- “আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)। মোঃ বিল্লাল হোসেন জুয়েল, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সমাজকর্ম, বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা।
।। প্রকাশক ও সম্পাদক : মো: শিহাব উদ্দিন ।। নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস. জয় ।।
দৈনিক জন জাগরণ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@২০২৫You cannot copy content of this page