পতিত সরকারের ডিজিটাল ধাক্কায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুট হয়েছে। এতে অন্তত ডজনখানেক ব্যাংক সংকটাপন্ন। দুর্বল দশা ঢাকতে টাকা ছাপানোসহ নানা অবৈধ সুবিধা দিয়ে আড়ালের চেষ্টায় মত্ত ছিলেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কিন্তু আগস্টে সরকার বদলের পর তিনি আত্মগোপন করায় দায়িত্বে আসা নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
কয়েকটি ব্যাংকের দুর্বল দশা পর্যবেক্ষণ করে গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর নামে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সোমবার দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি কোটি সহায়তা দিয়েছে। পরদিন (মঙ্গলবার) আরো দুই ব্যাংক পেয়েছে আড়াই হাজার কোটি। গভর্নর প্রাথমিকভাবে ৭০ হাজার কোটি টাকা সহায়তা ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্র জানায়, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে ৫টি ব্যাংককে ভল্ট থেকে সোমবার সাড়ে ১৮ হাজার কোটি দেওয়া হয়েছে। আর গতকাল অন্য দুটি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। মূলত আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাপক অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা বেসরকারিখাতের ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২০ আগস্ট গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে আর সহায়তা দেওয়া হবে না।
ব্যাংকের জন্য টাকা ছাপানো কোনো সমাধানের পথ নয়। এমনকি গত ৪ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেন, তারল্য সংকটে থাকা ‘দুর্বল’ ব্যাংকে সচল রাখতে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিয়ে গ্যারান্টির মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে নগদ টাকার ঋণ সহায়তা ব্যবস্থা করা হবে। সেই পদ্ধতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। কিন্তু তাতে সংকট মোকাবেলা না হওয়ায় টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা নিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবিএল)।
ন্যাশনাল ব্যাংক নিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা। অন্যান্য তিনটি ব্যাংক নিয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
একজন ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংকগুলো কত টাকা যোগান পেলে সংকট থেকে বের হতে পারবে, সেই তথ্য নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। পরে প্রতিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে পৃথকভাবে সভা করেছেন গভর্নর। তখন কোন ব্যাংককে কি পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন গভর্নর। সব মিলে ৭০ হাজার কোটি টাকার চাহিদা দিয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলো।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকগুলোর তারল্য সহায়তা নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে তারল্য সহায়তা ফের চালু করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপের এলসি খুলতে রাজি হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে রমজানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিশ্চিত করতে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ভোজ্যতেল, চিনি ও আটা-ময়দার কম্পানিগুলোর এলসি খুলতেও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যেসব ব্যাংক অর্থ সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তাদের সহায়তার জন্য খুব শিগগিরই আপনারা নতুন উদ্যোগ দেখতে পাবেন।’
আলোচিত ৫টি ব্যাংকসহ অন্তত ১২টি ব্যাংক আওয়ামী আমলের বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাংকের মালিকানায় এর আগে ছিল বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। এত অনিয়ম সত্ত্বেও শেখ হাসিনার আমলের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমতাবস্থায়, তারল্য সংকট আরো গভীর রূপ নেয়, কিন্তু এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকার পরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক বিধিমালা ভঙ্গ করে সহায়তার অনুমোদন দেওয়া হয়।
।। প্রকাশক ও সম্পাদক : মো: শিহাব উদ্দিন ।। নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস. জয় ।।
দৈনিক জন জাগরণ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@২০২৫You cannot copy content of this page