প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে যাত্রীবাহী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ক্রসিং ডিঙিয়ে হঠাৎ রেললাইনে উঠে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে সেটি চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের সামনে পড়লে বেশ কিছুদূর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই অটোরিকশার চার যাত্রী মারা যান। আহত চারজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও তিনজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন– বুড়িচংয়ের বাকশিমুল গ্রামের আলী আহাম্মদ, মনির হোসেনের স্ত্রী শাহিনুর আক্তার, আলী আশরাফের স্ত্রী সফরজান বেগম, মৃত আবদুল মালেকের স্ত্রী লুৎফা বেগম, অটোরিকশার চালক শাহজাহান মিয়া সাজু , খোদাইতলী গ্রামের মৃত ফজলু মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ও মৃত আছমত আলীর ছেলে রফিজ উদ্দিন ।
বুড়িচং থানার ওসি আজিজুল হক জানান, কালিকাপুর-বাকশিমুল সড়কের আশপাশে কয়েকটি বাজার, কলেজ-মাদ্রাসা থাকলেও ওই রেলক্রসিংয়ে কোনো প্রতিবন্ধক নেই। নিরাপত্তার অভাবে অটোরিকশা ক্রসিংয়ে উঠে পড়লে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণহানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আবদুল ওহাব স্থানীয় বাসিন্দা জানান, অবৈধ হলেও কালিকাপুর রেলক্রসিং শত বছরের পুরোনো। ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ও শত শত যানবাহন চলাচল করে। আবেদন করা হলেও রেল কর্তৃপক্ষ ক্রসিংটি বৈধ করে সেখানে নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। তাদের গাফিলতিতে সাত তাজা প্রাণ ঝরে গেল।
খবর পেয়ে কুমিল্লা থেকে রেলওয়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে জনতার তোপে পড়েন। এ সময় বিক্ষুব্ধরা অরক্ষিত ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানান। দাবি বাস্তবায়ন না হলে রেল চলাচল বন্ধের হুমকি দেন তারা।
এ বিষয়ে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (পথ) লিয়াকত আলী বলেন, দুর্ঘটনার জায়গাটি এলজিইডির। তারা উদ্যোগ নিলে ক্রসিংটি বৈধ করা যেত। আমরা আজ সেখানে সতর্কতার সাইনবোর্ড দিয়েছি। প্রতিবন্ধক (ব্যারিয়ার) তৈরি ও গেটম্যান দেওয়া হবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিভিশনাল ম্যানেজার এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, রেলক্রসিংটি অবৈধ ছিল। হঠাৎ অটোরিকশা যাত্রী নিয়ে লাইনে উঠে পড়ায় মর্মন্তুদ এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিবহন কর্মকর্তাকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
রেলওয়ে লাকসাম থানার ওসি এমরান হোসেন জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশগুলো স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে রেলওয়ে রসুলপুরের স্টেশনমাস্টার প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী মামলা করেছেন। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বুড়িচংয়ের ইউএনও সাহিদা আক্তার।
মনিরের অনাগত সন্তানের মুখ দেখা হলো না, ছেলে সৈকতকে স্কুলে দিয়ে অটোরিকশায় গাজীপুর বাজারে চিকিৎসক দেখাতে যাচ্ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা শাহিনুর আক্তার। ফিরে এসে দুপুরে স্বামী মনির হোসেন ও ছেলের সঙ্গে ভাত খাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তা আর হয়নি। ট্রেন দুর্ঘটনায় শাহিনুরসহ অটোরকিশার সাত যাত্রী মারা গেছেন।
বিকেলে শাহিনুরের লাশ বাড়িতে আনার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী-সন্তান। মনির হোসেন বলেন, আমার অনাগত সন্তানের জন্যই শাহিনুর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিল। দুপুরে সবাই একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। স্ত্রীকে হারালাম, অনাগত সন্তানের মুখ দেখাও হলো না।
শাহিনুরের শ্বশুর ইউসুফ মিয়া বলেন, শাহিনুর আমার মেয়ের মতো ছিল। সৈকত পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে। আমরা সবাই আরেক অতিথির জন্য উন্মুখ ছিলাম। ট্রেন সব কেড়ে নিল। সৈকতের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। রেল কর্তৃপক্ষ ক্রসিংয়ে লোক রাখলে তাদের এমন মৃত্যু হতো না।
কুমিল্লায় রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, রেলওয়ের লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৭১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৩৩টি বৈধ ও ৩৮টি অবৈধ। অবৈধ লেভেলক্রসিংগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, এলজিইডিসহ বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগুলো অনুমোদন দেওয়া হবে। জনস্বার্থে অবৈধ ক্রসিংগুলো অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
।। প্রকাশক ও সম্পাদক : মো: শিহাব উদ্দিন ।। নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস. জয় ।।
দৈনিক জন জাগরণ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@২০২৫You cannot copy content of this page