মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্র কি ব্যর্থ হয়েছে? সবাই এক বাক্যে বলবে হ্যাঁ। আমি বলব না। বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনার দাবি রাখে। সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক নেতা কার্ল মার্কস। সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়নকারী মহামতি লেনিন, মাওসেতুং, ফিডেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ। লেনিনই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের ঢেউ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক পার্টিতে পরিণত হয়। কলোনির যাতাকল থেকে মুক্ত হয়ে প্রত্যেক দেশই কমিউনিস্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সর্বত্র সমাজতন্ত্রের দাবি ওঠে। এমনকি মুসলিম দেশগুলোতেও। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সমাজতন্ত্র ঠেকানোর জন্য হত্যা, গুপ্তহত্যার আশ্রয় নেয়, সামরিক বাহিনীকে উস্কে দেয়, ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে। এমনকি মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করে। তারপরেও সমাজতন্ত্রের দাবি থামছে না। খোদ ইউরোপ- আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
তখন পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা চিন্তা করতে লাগলো, মানুষ কেন সমাজতন্ত্র চায়? কীভাবে সমাজতন্ত্র ঠেকানো যায়? অভাবের কারণে মানুষ সমাজতন্ত্র চায়। তাই মানুষের অভাব তথা দারিদ্র দূর করতে হবে। রাষ্ট্রকে করতে হবে জনকল্যাণমুখী। নাগরিকের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের দায়িত্ব নিতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে বেকারভাতা দিতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকা তথা উন্নত দেশগুলো তাই করেছে এবং সমাজতন্ত্রকে ঠেকিয়েছে। এক পর্যায়ে ১৯৯১ সালে তারা সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার সোভিয়েত ইউনিয়নকে ১৫টি খণ্ডে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এসব সত্ত্বেও আমি মনে করি, মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্র পুরোপরি ব্যর্থ হয়নি। সমাজতন্ত্রের কারণেই আজ বিশ্ব জনকল্যাণের দিকে ঝুঁকেছে এবং ঝুঁকছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছে। মানুষ অধিকার পাচ্ছে। রাষ্ট্র শোষক ও শাসকের পরিবর্তে সেবকে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এ সবই হয়েছে এবং হচ্ছে কার্ল মার্কসের বদৌলতে।
অথচ মার্কস ছিলেন অধিকার বঞ্চিত, সুবিধা বঞ্চিত। অপারমেধার অধিকারী হয়েও মার্কস ছিলেন অভাব অনটনে জর্জরিত। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে তার সন্তানের মৃত্যু হয়। মার্কসকে তার লেখনীর জন্য পালিয়ে বেড়াতে হয়। শেষে আশ্রয় নেন ইংল্যান্ডে। তিনি সকালে পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যেতেন আর রাতে বাসায় ফিরতেন। তাঁর বন্ধু ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস অর্থ দিয়ে তার পরিবারকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখতেন। লোকটি নিজের জন্য কিছুই করেননি। সারাজীবন মানুষের জন্য ভেবেছেন, লিখেছেন। কীভাবে নিপীড়িত শোষিত মানুষকে মুক্তি দেওয়া যায়, মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠা করা যায়—সে সাধনাই করে গেছেন।
কার্ল মার্কসের পিতা হেনরিখ মার্কস ছিলেন আইনজীবী। পিতার ইচ্ছা ছিল পুত্র আইন নিয়ে পড়ুক। মার্কস আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। পিএইচডি করেন দর্শনে। তাও করেন দুই মাসে। তিনিই প্রথম দুই বছরের পিএইচডি করেন দুই মাসে। উনিশ শতকে জার্মানিতেও শিল্প বিপ্লবের ঢেউ লাগে। মার্কস দোতলার বারান্দায় বসে দেখতেন শত শত লোকজন ভোরে কারখানায় যায় কাজ করতে, ফিরে রাতে। তারা ভালো মজুরি পেত না, ভালো খাবার পেত না, ভালো পোশাক পেত না। তাদের বাসস্থান ছিল বস্তিতে। তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেত না। তারা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। শ্রমিকের কোনো উন্নতি নেই। তারা কায়ক্লেশে কোনোমতে জীবনযাপন করত। অথচ মালিক ধনী থেকে ধনী হচ্ছে। এ তো মহা শোষণ। বিষয়টি কার্ল মার্কসকে ভাবায়। তাই তিনি শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে মনস্থির করেন। মেহনতি মানুষকে মুক্তির শপথ নেন। লিখতে থাকেন মানবমুক্তির দর্শন; যাকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। তার বহু গ্রন্থের মধ্যে ‘দাস ক্যাপিটাল’ ও ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ অন্যতম। আর এ গ্রন্থদ্বয় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বাইবেল বা ভিত্তি। আজ ৫ মে এ মহান মানুষটির জন্মদিন। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি তাকে।
।। প্রকাশক ও সম্পাদক : মো: শিহাব উদ্দিন ।। নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস. জয় ।।
দৈনিক জন জাগরণ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@২০২৫You cannot copy content of this page